অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন : পর্ব ৫ (শেষ পর্ব )
অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতন:
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের দাবি নিয়ে তরুণ তুর্কি বিপ্লবের সূচনা ঘটে। পাশ্চাত্যের আদর্শে দীক্ষিত ইসলামবিরোধী এ বিপ্লবীরা তুর্কি জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা প্রসার ঘটায়।এই অবস্থায় ক্ষমতায় আসেন সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ (১৮৭৬-১৯০৯)। তিনি তাদেরকে বিতাড়িত করেন,যার ফলস্বরুপ ১৯০৬ সালে সেলোনিকায় তারা আনোয়ার পাশার নেতৃত্বে কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রগ্রেস গঠন করে। দুই বছরের মাথায় তারা রাজধানী কন্সটেন্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) এ এসে উসমানীয় সাম্রাজ্যের উপর ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে,যা মূলত উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের মুখ্য কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
এ সময় অটোম্যান সাম্রাজ্যের শাসনের মূল ক্ষমতা কমিটি অব ইউনিয়ন এন্ড প্রগ্রেসের প্রধান ও যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশার হাতে চলে যায়। রাষ্ট্রের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ইসলামবিদ্বেষী সেক্যুলারপন্থী দের নিয়োগ করা হয়। একে একে ছাটাই করে দেয়া হয় ইসলামপন্থীদের। ১৯০৯ সালে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ পদচ্যুত হন। সিংহাসনে আরোহণ করেন তার ভাই সুলতান মুহাম্মদ রাশেদ বা পঞ্চম মুহাম্মদ। ইসলামের পবিত্র ভূমিতে পাশ্চাত্যের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ ই ছিলেন মুসলিমদের শেষ প্রতিরোধ শক্তি। এসময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। অটোম্যান বাহিনী জার্মানির পক্ষ অবলম্বন করে মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। এই মহাযুদ্ধে পরাজয়ের ফলে অটোম্যান সাম্রাজ্য দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
১৯১৪ সালে ব্রিটেন কর্তৃক বাসরা দখল হয়ে যায়। ১৯১৫ সালে অটোম্যান বাহিনী বনাম ব্রিটেন,ফ্রান্স,অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের যৌথ বাহিনীর মধ্যে গ্যালিপলি যুদ্ধ এর সূচনা হয়। ১৯১৬ সালে আর্মেনীয়দের সহায়তায় রাশিয়ান বাহিনী পূর্ব আনাতোলিয়ার বিশাল অংশ দখল করে নেয়। একই বছরে শরীফ হোসাইন ব্রিটেনের সহায়তায় অটোম্যানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে সকল আরব অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয় অটোম্যান বাহিনী। অন্যদিকে আরব জাতীয়তাবাদের উত্থান এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য থেকেও বিতাড়িত হয় অটোম্যানরা। ১৯১৮ সালে মিত্র শক্তি কনসট্যান্টিনোপল দখল করে নেয় এবং এবং পতন ঘটে আনোয়ার পাশার নেতৃত্বাধীন সরকারের।”মুদরুস যুদ্ধবিরতি চুক্তি” থাকা সত্বেও আরব মিত্রদের সহায়তায় ব্রিটেন কর্তৃক ইরাকের মসুল দখল হয়।
১৯১৮ সালে জার্মানি পরাজিত হয়ে যুদ্ধবিরতিতে স্বাক্ষর করে। ওই বছরই সুলতান পঞ্চম মুহাম্মদ মৃত্যুবরণ করলে সুলতান মুহাম্মদ ওয়াহিদুদ্দীন বা ষষ্ঠ মুহাম্মদ সিংহাসনে বসেন।১৯১৯ সালে ইতালীয় বাহিনী কুনিয়া পর্যন্ত আনাতোলিয়া বিশাল অঞ্চল দখল করে নেয় এবং গ্রিক বাহিনী কর্তৃক থ্রেস ও ইজমির প্রদেশসহ পশ্চিম আনাতোলিয়ার বিশাল অঞ্চল দখল হয়ে যায়। ১৯২০ সালে “সেভ্রে চুক্তি” এর ফলে অটোম্যান সাম্রাজ্যের আয়তন ব্যাপকভাবে হ্রাস পায় যা তুর্কি স্বাধীনতা যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে।
ক্ষুব্ধ তুর্কি বিপ্লবীরা অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে থাকে। তাদেরকে শান্ত করতে সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ সেনাপতি মুস্তফা কামাল পাশাকে প্রেরণ করেন। কিন্তু কামাল পাশা নিজেই সেক্যুলার পন্থী হওয়ায় সে বিদ্রোহীদের সাথে নিয়ে একটি নির্বাহী পরিষদ গঠন করে। ১৯২০ ও ১৯২১ সালে কামাল পাশার নেতৃত্বে তুর্কি সৈন্যরা পরপর কয়েকটি যুদ্ধে মিত্রবাহিনী ও গ্রিক বাহিনীকে পরাজিত করে তাদেরকে আনাতোলিয়া হতে বিতাড়িত করে। “কার্স চুক্তি”র ভিত্তিতে আর্মেনিয়া,জর্জিয়া ও আজারবাইজান এর সাথে বর্তমান তুরস্কের সীমান্ত চিহ্নিত হয়। “আংকারা চুক্তি” এর ফলে আনাতোলিয়া হতে ফরাসি বাহিনী প্রত্যাহার ও সিরিয়ার সাথে সীমান্ত চিহ্নিত করা হয়। ১৯২২ সালে গ্রিক বাহিনীকে পরাজিত করে তুর্কি বাহিনী ইজমির প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ লাভ করে।এ যুদ্ধ তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধ হিসেবে খ্যাত। ফলে কামাল পাশার নেতৃত্বাধীন সরকার তুর্কিদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করে।
১৯২২ সালে এই সরকার সুলতান পদের বিলুপ্তি ঘোষণা করলে সুলতান ষষ্ঠ মুহাম্মদ দেশ থেকে নির্বাসিত হন। ১৯২৩ সালে”লুজেন চুক্তি” এর ভিত্তিতে পূর্ব থ্রেস ও কনস্টান্টিনোপল তুর্কিদের ফিরিয়ে দেয়া হয়।মুস্তফা কামাল পাশার নেতৃত্বে ১৯২৪ সালে খেলাফত উচ্ছেদ হয় এবং আনাতোলিয়ায় নতুন প্রজাতন্ত্র রূপে অভ্যুদয় ঘটে আধুনিক তুরস্কের। এজন্য মুস্তফা কামাল পাশা কে আধুনিক তুরষ্কের জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়।আর এরই মধ্য দিয়ে এককালের মহা পরাক্রমশালী এই অটোম্যান সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।
১ম পর্ব- অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ১)
২য় পর্ব- অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ২)
৩য় পর্ব- অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ৩)
৪র্থ পর্ব-অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ৪)