অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ১ )

জ্ঞান বিজ্ঞান ও আভিজাত্যে গোটা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেয়া এককালের মহা পরাক্রমশালী স্পেনের মুসলিম সাম্রাজ্য তখন বিলুপ্তির পথে, যৌবনের সব জৌলুস হারিয়ে বাগদাদের আব্বাসী খেলাফত তখন বয়সের ভারে নুইয়ে পড়েছে, মুসলিম উম্মাহর নব উত্থানে স্বপ্নদ্রষ্টা হয়ে আবির্ভূত হওয়া সেলজুক সাম্রাজ্যও তখন তার সকল পরাক্রম হারিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় ব্যস্ত,অন্যদিকে ধংসাত্নক মঙ্গল শক্তি প্রতিটি মুসলিম জনপদে খুন,লুণ্ঠন আর হত্যাযজ্ঞের পৈশাচিক খেলায় লিপ্ত। গোটা দুনিয়া তখন ভাবছিল এই বুঝি মুসলিমদের গৌরবময় শাসন-ধারার সমাপ্তি ঘটল। এমনই এক ক্রান্তিলগ্নে মুসলমানদের আবার নতুনভাবে জাগ্রত করতে আবির্ভাব ঘটে এক যাযাবর যোদ্ধার যার উত্তরসুরিরা সুদীর্ঘকাল কালিমার ঝাণ্ডা উড়িয়েছে, শাসন করেছে তিন মহাদেশ পরিমাণ বিস্তৃত এলাকা।

অটোম্যান সাম্রাজ্যের পরিচিতি :

অটোম্যান সাম্রাজ্য ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও সবচেয়ে বেশিদিন টিকে থাকা সাম্রাজ্য। তুরস্কের ইস্তাম্বুল থেকে সারা পৃথিবীর তিনটি মহাদেশ শাসন করা এই রাজবংশ টিকে ছিল ৬২৪ বছর। ইউরোপ থেকে শুরু করে এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এই সাম্রাজ্য। মুসলিম এই রাজবংশের শাসনতলে ছিল বর্তমান বিশ্বের ইউরোপের ক্ষমতাধর ফ্রান্স, হাংগেরি, বুলগেরিয়া সহ প্রায় সকল দেশই। এছাড়া ৬২৪ বছর ব্যাপী  অটোম্যান  সাম্রাজ্য  শাসন  করেছে  এশিয়া  ও আফ্রিকার  দেশসমূহ  সহ  বর্তমান  বিশ্বের  প্রায়  শতাধিক  দেশ

অটোম্যান  সাম্রাজ্যের  উত্থান :

অটোম্যান  সাম্রাজ্য বা উসমানীয়  সাম্রাজ্যের  প্রতিষ্ঠাতা  প্রথম  উসমানের  বাবা  আরতুগ্রুল  গাজীই  মূলত  অটোম্যান  সাম্রাজ্যের  ভিত্তিপ্রস্তর  করে যান। আরতুগ্রুল  গাজী ১১৯৮ খ্রিষ্টাব্দের  কোন এক সময়ে আনাতোলিয়ার  আহলাত  শহরে  জন্মগ্রহণ  করেন। তার  পিতার নাম সুলাইমান  শাহ। সুলাইমান  শাহ ছিলেন “কায়ী ” নামক এক  যাযাবর  গোষ্ঠীর  প্রধান। সুলাইমান  শাহ  এর সেনাবাহিনীর  অন্যতম  যোদ্ধা  ছিলেন সন্তান আরতুগ্রুল।এই কায়ী গোষ্ঠী প্রথমে খোরাসনে বসতি স্থাপন করেছিল। হিজরি ৭ম শতকের একদম প্রথম দিকে চেঙ্গিস  খানের মঙ্গল বাহিনী খোরাসান আক্রমণ করলে তারা খোরাসান ছেড়ে  আর্মেনিয়া চলে যায়  ও সেখানে বসতি স্থাপন করে। চেঙ্গিস খানের দস্যুতার কারণে তখন সব মানুষকে জান মালের জন্য নিজের বাহুবলের উপর নির্ভর করতে হত ও সর্বক্ষণ  সচেতন থাকতে  হত।

চেঙ্গিস খান তার মৃত্যুর তিন বছর আগে ১২২৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে সেলজুক সাম্রাজ্যের রাজধানী কনিয়া আক্রমণ করেন, কনিয়ার শাসন ক্ষমতায় তখন ছিলেন আলাউদ্দিন কায়কোবাদ সেলজুকি। কালের পরিক্রমায় সেলজুক সাম্রাজ্য তখন ছিল দুর্বল। সেলজুক সাম্রাজ্যের উপর চেঙ্গিস খানের আক্রমণের এই সংবাদ সুলাইমান শাহের নিকট পৌঁছে গেল। সুলাইমান শাহ আলাউদ্দিন কায়কোবাদ  কে সাহায্য করতে চাইলেন এবং তার সৈন্যবাহিনীর যে অংশকে অগ্রবর্তী বাহিনী হিসেবে সুলতান এর সাহায্যার্থে পাঠিয়েছিলেন তার নেতৃত্বে  ছিলেন আরতুগ্রুল এবং সেখানে  সৈন্য সংখ্যা ছিল  ৪৪৪।

আরতুগ্রুল তার বাহিনী নিয়ে পৌঁছানোর আগেই চেঙ্গিস বাহিনী সেলজুক বাহিনীকে কোণঠাসা করে ফেলেছিল এবং প্রায়ই পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে  গিয়েছিল সেলজুক বাহিনী। আরতুগ্রুল তার বাহিনী নিয়ে পৌঁছেই অত্যন্ত দৃঢ়তা ও ক্ষিপ্রতার সাথে চেঙ্গিস বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়েন। আরতুগ্রুল বাহিনীর  অকস্মাৎএই আক্রমণে মঙ্গলরা আর টিকতে পারল না। তারা তাদের সৈন্যদের অসংখ্য লাশ  ফেলে রেখেই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়ন করল। কিছুক্ষণ আগেই সুলতান আলাউদ্দিন যেখানে পরাজয় অবধারিত ভেবেছিলেন সেখানে আরতুগ্রুল এর হঠাৎ এরূপ সাহায্যে বিজয় লাভ করে তিনি আরতুগ্রুল কে জরিয়ে ধরলেন এবং পুরষ্কার স্বরূপ আংকারার  নিকট কিছু জায়গা প্রদান করেন। অনেকের মতেই  আরতুগ্রুলকে  এমন জায়গায়  ভূমি প্রদানের কারণ ছিল যাতে আরতুগ্রুল বাইজেন্টাইন বা অন্যান্য প্রতিপক্ষের কাছ থেকে আসা হামলা প্রতিহত করতে পারেন। কিছুদিন পর আরতুগ্রুল রোমান এক বাহিনীকে পরাজিত করে রোমান এলাকার দিকে নিজের পরিধি  বৃদ্ধি করেন । ১২৩১ সালে তিনি সাগুত  ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকা জয় করেছিলেন। ১২৫৮ সালে আরতুগ্রুল এর ঘর আলো করে আসে এক পুত্রসন্তান,যার নাম উসমান খান।

 

অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা : উসমান খান                         উসমান খান

এই উসমান খানই হচ্ছেন অটোম্যান সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। ১২৮৮ সালে আরতুগ্রুল এর মৃত্যুর পর উসমান খান বাবার অধিকৃত এলাকার শাসনক্ষমতা গ্রহণ করেন। অন্যদিকে ১২৩৬ সালে আলাউদ্দিন কায়কোবাদ এর মৃত্যুর পর তার পুত্র গিয়াসুদ্দিন কনিয়ার সিংহাসন এ আরোহণ করেছিলেন। উসমান খান এর  যোগ্যতার পরিচয় পেয়ে গিয়াসুদ্দিন তাকে নিজ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করেন ও নিজ কন্যার  সাথে বিবাহ প্রদান করেন। উসমান খান এরপর কনিয়াতে বসবাস শুরু করেন ও নিজ যোগ্যতাবলে পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী পদে উন্নীত হন। ১২৯৯ সালে মঙ্গলদের সাথে এক যুদ্ধে গিয়াসুদ্দিন নিহত হন । তার কোন পুত্রসন্তান না থাকায় একমাত্র কন্যার স্বামীকেই সভাসদরা  কনিয়ার সুলতান হিসেবে গ্রহণ করেন।এভাবেই সেলজুক সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে ও সেখানে কায়েম হয় উসমানীয় সাম্রাজ্য বা অটোম্যান সাম্রাজ্য।

২য় পর্ব- অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ২)
৩য় পর্ব- অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ৩)
৪র্থ পর্ব-অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ৪)
৫ম পর্ব- অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ৫)

Similar Posts