অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ২ )

সাম্রাজ্য বিস্তৃতি, ক্ষমতা ও দাপট :

সিংহাসন লাভের পরপরই উসমান খান মৃতপ্রায় এই সাম্রাজ্য পুনরায় জাগ্রত করে তোলেন। তিনি প্রথমে রোমান খ্রিষ্টানদের উপর আক্রমণ করে তাদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করেন এবং কারা হিসার  শহর দখল করে সেখানে আপন রাজধানী স্থানান্তর করেন। তার ন্যায়নিষ্ঠতা, বিচক্ষণতা  এবং প্রজাদরদী মনোভাবের কারণে তিনি প্রজাসাধারণের নিকট অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেন।তিনি বায়েজেন্টাইন সাম্রাজ্যের প্রান্ত পর্যন্ত সীমানা বিস্তৃত করেন।উসমানের ছেলে প্রথম ওরহান ১৩২৪ সালে  বায়েজেন্টাইনদের সমৃদ্ধশালী শহর বুরসা জয় করেন এবং একে উসমানীয়দের নতুন রাজধানী করা হয়। বুরসার পতনের ফলে বায়েজেন্টাইনরা উত্তর  পশ্চিম আনাতোলিয়ার নিয়ন্ত্রণ হারায়।

১৩৫৬ সালে ওরহানের পুত্র সুলাইমান খান গ্যালিপোলি উসমানীয়দের অধিকারে আনেন। ইউরোপীয়দের হস্তক্ষেপ থেকে এশিয়া মাইনর এর পশ্চিম উপকূল সুরক্ষিত রাখতে এ শহরের  গুরুত্ব অপিরিসীম ছিল। সুলতান ওরহানের  পৃষ্ঠপোষকতায় সর্বপ্রথম বন্দী খ্রিষ্টান শিশুদের ইসলামী শিক্ষা ও অন্যান্য সামরিক বিদ্যায় পারদর্শী করে গড়ে তোলা হয় “জেনিসারি” নামক বিশেষ রাজকীয় বাহিনী। উসমানীয়দের  ইতিহাসে এই বাহিনীর গুরুত্ব অপরিসীম। ১৩৬০ সালে ওরহানের পুত্র সুলতান প্রথম মুরাদ সেনা নিয়ে ইউরোপ উপকূলে অবতরণ করেন এবং আন্দ্রেয়ানোপোল জয় করে সেখানে আপন রাজধানী স্থানান্তর করেন। এতে ভীত হয়ে কন্সটেন্টিনোপোল  সম্রাট রোমের পোপকে ধর্মযুদ্ধ তথা ক্রসেডের ডাক দিতে বলেন। ফলে ১৩৭১ সালে পোপের আহবানে সার্বিয়া , বুলগেরিয়া, হাঙেরি, বোসনিয়া এর ১ লক্ষ সৈন্যের বিশাল যৌথবাহিনী  আন্দ্রেয়ানোপোল আক্রমণ করে। কিন্তু উসমানীয় বাহিনীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। ১৩৮০ সালে পুনরায়  কন্সটেন্টিনোপোল  সম্রাট রোমের পোপকে বিনীতভাবে অনুরোধ করেন তিনি যেন একটি ব্যাপকভিত্তিক ক্রসেডের ডাক দেন এবং ইউরোপের সমস্ত শক্তিকে  এক পতাকাতলে এনে উসমানীয়দের বিরুদ্ধে দাঁড় করান। অবশেষে ১৩৮৯ সালে ইউরোপের সমস্ত দেশ ও জাতি সকল ভেদাভেদ ভুলে উসমানীয় বা অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে একজোট হয়।

এ খবর শুনে সুলতান মুরাদ এশিয়া মাইনর থেকে আন্দ্রেয়ানোপোল এসে  আপন সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করেন এবং শাহজাদা বায়েজিদ কে সঙ্গে নিয়ে কসোভোর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। মুসলিম বাহিনী সৈন্যসংখ্যা ও রসদপত্রের দিক থেকে খ্রিষ্টান বাহিনীর মাত্র এক চতুর্থাংশের সমান ছিল। এছাড়া দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তারা অত্যন্ত ক্লান্তও ছিল। সেজন্য এ যুদ্ধ মুসলিম বাহিনীর জন্য অত্যন্ত কঠিন ছিল। কিন্ত আল্লাহ এর অশেষ রহমতে শেষ পর্যন্ত উসমানীয়দের জয় হয়। কসোভোর যুদ্ধ ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ এক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে অসংখ্য খ্রিষ্টান সেনার মৃত্যু ঘটে এবং সার্বিয়ার সম্রাটসহ অসংখ্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় এক বন্দী কর্মকর্তার আচমকা ছুরিকাঘাতে সুলতান প্রথম মুরাদের মৃত্যু হয়। এ যুদ্ধ জয়ের ফলে অত্র অঞ্চলে সার্বিয়ান শক্তির সমাপ্তি ঘটে। ফলে ইউরোপের দিকে উসমানীয়দের অগ্রযাত্রা সহজ হয়। এ যুদ্ধের ফলে ইউরোপে মুসলিমদের প্রভাব প্রতিপত্তি সুদৃঢ় হয়।

সুলতান মুরাদের পর তার পুত্র বায়েজিদ ইলদিরিম (প্রথম বায়েজিদ) ১৩৮৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠাতা প্রথম উসমানের পর থেকে অটোম্যান সুলতানগণ একটি প্রশংসনীয় রীতি অনুসরণ করতেন আর তা হল মুসলিম ভূখণ্ডে আক্রমণ করা থেকে বিরত থেকে যথাসম্ভব ইউরোপের দিকে ইসলামের জয়যাত্রা অব্যাহত রাখা। সুলতান বায়েজিদ ও এই নীতির বাইরে যেতে চাননি। কিন্তু তুর্কি সেলজুকরা ক্রমাগত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে থাকলে ১৩৯৩ সালে সুলতান বায়েজিদ এশিয়া মাইনরের দিকে মনোনিবেশ করেন এবং ১৩৯৬ সালে তা অটোম্যান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। অন্যদিকে গত তিন বছর যাবৎ ইউরোপের যুদ্ধক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকায় হাঙ্গেরির সম্রাটের নেতৃত্বে ইউরোপের সকল রাজশক্তি অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সকল যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পন্ন করে ফেলে। এবার ব্রিটেন এবং ফ্রান্স ও তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে এই যুদ্ধে উসমানীয়দের বিরুদ্ধে যোগ দেয়। এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাকে পাপ মোচনের সুবর্ণ সুযোগ মনে করে পরিপূর্ণ ধর্মীয় উন্মাদনায় গোটা ইউরোপের সবচেয়ে অভিজ্ঞ সেনাপতিদের নিয়ে খ্রিষ্টানরা অটোম্যানদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে থাকে। অবশেষে ১৩৯৬ সালে মুসলিম বাহিনী ও খ্রিষ্টান বাহিনী নিকোপলিসে পরস্পরের মুখোমুখি হয়।রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধে অটোম্যানরা খ্রিষ্টানদের শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে। কথিত আছে সেদিন বায়েজিদের বাহিনী এমন এক লৌহদন্ডে পরিণত হয়েছিল যে মাইলের পর মাইল খ্রিষ্টান বাহিনীকে তারা চূর্ণ-বিচূর্ণ করে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়।

এ যুদ্ধ জয়ের ফলে অধিকাংশ বলকান অঞ্চল তথা গ্রিস,সার্বিয়া,মন্টেনিগ্রো,ক্রোয়েশিয়া,বুলগেরিয়া,রোমানিয়া,মেসিডোনিয়া,আলবেনিয়া, বস্নিয়া প্রভৃতি দেশ সমূহ বিজিত হয়। নিকোপলিসের যুদ্ধ কে মধ্যযুগীয় শেষ ব্যাপকভিত্তিক ক্রসেড হিসেবে দেখা হয়। খ্রিষ্টানদের এরূপ বারবার সীমা লঙ্ঘনের কারণে সুলতান বায়েজিদ ক্ষুব্ধ হয়ে সমস্ত ইউরোপ বিজয় করার সংকল্প গ্রহণ করেন। তিনি যখন গ্রিক ও এথেন্স জয় করেন, তখন ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম খলনায়ক মহাবীর তৈমুর লং বায়েজেন্টাইন সম্রাটের প্ররোচনায় অটোম্যানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এ সংবাদ শুনে সুলতান বায়েজিদ আপন সাম্রাজ্যে ফিরে আসেন এবং আঙ্কারায় তৈমুর এবং বায়েজিদের বাহিনীর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ১৪০২ সালে সংঘটিত এই যুদ্ধে তৈমুর উসমানীয় বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং সুলতান বায়েজিদ কে বন্দী করেন। বন্দী অবস্থায় সুলতান বায়েজিদের মৃত্যুর পর তার পুত্রদের মধ্যে উত্তরাধিকার নিয়ে সংঘটিত গৃহযুদ্ধ ১৪০২ থেকে ১৪১৩ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। শেষ পর্যন্ত ১৪১৩ সালে মুহাম্মদ (১ম) সুলতান হন এবং অটোম্যান সাম্রাজ্যের ক্ষমতা সুসংহত করেন। সুলতান প্রথম মুহাম্মদ এর পর তার পুত্র মুরাদ খান(২য়) ১৪২১ সালে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। দ্বিতীয় মুরাদের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বায়েজেন্টাইনদের ষড়যন্ত্রে উসমানীয় সাম্রাজ্যে একের পর এক বিদ্রোহ দানা বেঁধে ওঠে। সুলতান মুরাদ তা দমন করতে করতে এক পর্যায়ে ক্ষুব্ধ হয়ে কন্সটেন্টিনোপোলের পতন ঘটানোর সিদ্ধান্ত নেন। ১৪২১ সালে তিনি বায়েজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দিকে অগ্রসর হয়ে রাজধানী কন্সটেন্টিনোপোলের ওপর তীব্র অবরোধ গড়ে তোলেন।

কন্সটেন্টিনোপোল যখন পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে সেই সময়ে বায়েজেন্টাইন সম্রাটের প্ররোচনায় তার ভাই মোস্তফার নেতৃত্বে এক ভয়াবহ বিদ্রোহ দেখা দেয়। উক্ত বিদ্রোহ দমন করতে সুলতান মুরাদ কন্সটেন্টিনোপোল থেকে ফিরে আসেন এবং তার ভাই মোস্তফা কে মৃত্যুদণ্ড দেন। ফলে এই যাত্রায় পতনের হাত থেকে রক্ষা পায় কন্সটেন্টিনোপোল।১৪৩০ এর দশকে সুলতান মুরাদ গ্রীসের দক্ষিণাঞ্চল, সেলোনিকা, মেসিডোনিয়া সহ বলকানের বিশাল অঞ্চল জয় করেন। ১৪৩৯ সালে সার্বিয়াকে আপন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হন। এরপর হাঙ্গেরি সম্রাট লাডিস্লো ও তার সেনাপতি জন হানয়াডির নেতৃত্বে খ্রিষ্টানরা কয়েকটি যুদ্ধে অটোম্যানদের পরাজিত করতে সক্ষম হয়। খ্রিষ্টানদের এই সাফল্যে মুগ্ধ হয়ে রোমের পোপ পুনরায় ধর্মযুদ্ধের তথা ক্রসেডের আহ্বান জানান। ফলে ইউরোপের সকল শক্তি পুনরায় নব উদ্যম অটোম্যানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করে।

১৪৪৩ ও ১৪৪৪ সালে সংঘটিত বেশ কয়েকটি যুদ্ধে উভয়পক্ষই ব্যাপক প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অবশেষে ১৪৪৪ সালের ১০ নভেম্বর তিনি সম্রাট লাডিস্লো ও জন হানয়াডির অধীন হাঙ্গেরিয়ান, পোলিশ ও ওলাশিয়ান বাহিনীকে ভারনার যুদ্ধে পরাজিত করেন। এসময় লাডিস্লো যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হয়। সেনাপতি জন হানয়াডি পালিয়ে গিয়ে জীবন রক্ষা করেন। এটি ভারনার ক্রসেডের শেষ যুদ্ধ। তবে আলবেনীয়রা সিকান্দার বেগ এর অধীনে অটোম্যানদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ অব্যাহত রাখে। চার বছর পর, পুনরায় অটোম্যানদের উপর আক্রমণ করার জন্য জন হানয়াডি হাঙ্গেরিয়ান ও ওলাশিয়ানদের আরেকটি বাহিনী প্রস্তুত করেন। তবে ১৪৪৮ সালে কসোভোর দ্বিতীয় যুদ্ধে তিনি সুলতান মুরাদের কাছে পরাজিত হন।১৪৫১ সালের ৩রা ফেব্রুয়ারি সুলতান দ্বিতীয় মুরাদ মৃত্যুবরণ করেন। নি:সন্দেহে তিনি শ্রেষ্ঠতম উসমানীয় সুলতানদের একজন।

( চলবে )

১ম পর্ব- অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ১ )
৩য় পর্ব- অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ৩)
৪র্থ পর্ব-অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ৪)
৫ম পর্ব- অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ৫)

Similar Posts