ইউটোপিয়া নাকি ডিস্টোপিয়া! কোনটি সবচেয়ে নিকটবর্তী?

ইউটোপিয়া নাকি ডিস্টোপিয়া! কোনটি সবচেয়ে নিকটবর্তী? জানতে হলে আপনাকে অবশ্যই আগে ইউটোপিয়া এবং ডিস্টোপিয়া মতবাদ দুটির ব্যাপারে স্বচ্ছ ধারণ থাকতে হবে। যারা ইতোমধ্যে অবগত আছেন তাদের নিশ্চই জবাব দিতে দেরি হবে না। কিন্তু সে উত্তরে যাবার আগে যারা এখনো জানেন না, তাদেরকে বলছি। খুব ছোট করে বলতে গেলে- আমরা সবাই যে নিখুঁত সমাজ ব্যবস্থা বা বিশ্বের স্বপ্ন দেখি সেটাই হলো ইউটোপিয়া। আর, এর ঠিক বিপরীত হলো ডিস্টোপিয়া। অর্থাৎ, যে ভয়ঙ্কর সমাজ ব্যবস্থার দুঃস্বপ্ন থেকে আমরা প্রতিনিয়ত পালিয়ে বেড়াই তা-ই ডিস্টোপিয়া।

ইউটোপিয়া নাকি ডিস্টোপিয়া

আপনার স্বপ্ন দেখার পরিধিটা যত বড় আপনার ইউটোপিয়াটাও তত বিস্তৃত হবে। আর আপনার দুঃস্বপ্নের ভয়াবহতা যত বেশী হবে আপনার ডিস্টোপিয়াটাও তত বিপজ্জনক হবে। যদিও ভালো-খারাপ এ দুই নিয়েই মানুষের জীবন। ভালোর পরে খারাপ আর খারাপের পরে ভালো সময় আসে।

ইউটোপিয়া নাকি ডিস্টোপিয়া- এ দুয়ের মধ্যে সবচেয়ে নিকটবর্তী ভবিষ্যতটির সন্ধ্যান অনেকাংশে নির্ভর করছে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির উপর। আমাদের মধ্যে কেউ আছেন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির। আবার অনেকে আছেন নেতিবাচকতা দিয়ে সবকিছু যাচাই করেন। চলুন, আমাদের এই দ্বৈত দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে ইউটোপিয়ান এবং ডিস্টোপিয়ান ভবিষ্যতকে যাচাই করে দেখি।

ইউটোপিয়ান ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

আমরা প্রথমে আমাদের ইতিবাচকতা দিয়ে পর্যালোচনা করার চেষ্টা করি। অর্থাৎ দেখে নিই, কোন কোন ক্ষেত্রে ইউটোপিয়া আমাদের সবচেয়ে নিকটবর্তী।

১/ উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা

কমপক্ষে চাকা উদ্ভাবনের সময় থেকে ভাবলেও আমরা অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি। এখন হয়ত আপনি কফি খেতে খেতে আপনার বন্ধুর সাথে অন ডিমান্ড রাইড থেকে শুরু করে মহাকাশে হাইপারলুপ নিয়ে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েন।

গুগল কার ও টেসলা শহর জুড়ে চালক ছাড়া স্বয়ংক্রিয় গাড়ির ধারণাকে সম্পূর্ণ বাস্তবে রূপ দিতে পেরেছে। যা পরবর্তীতে জ্বালানী অর্থনীতির পাশাপাশি পরিবর্তন করে দিবে গাড়ির মালিকানা পদ্ধতি। তাছাড়া ইতোমধ্যে রেডিও তরঙ্গের বহুল ব্যবহারের ফলে গাড়ির অবস্থান সনাক্তকরণ, অতিক্রান্ত দূরত্ব, নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌছাতে অতিবাহিত সময় সব জানা সম্ভব হচ্ছে।

এছাড়া বড় বড় ধাপ ফেলে প্রতিনিয়ত অগ্রসর হচ্ছে ড্রোন, বুলেট ট্রেন, ভূ-গর্ভস্থ রেলগাড়ির মত অত্যাধুনিক পরিবহন ব্যবস্থাগুলো।

২/ প্রতিনিয়ত অগ্রগামী যোগাযোগ ব্যবস্থা

শুধু এই যোগাযোগ প্রযুক্তির দিক থেকে ভাবলেই, ইউটোপিয়া নাকি ডিস্টোপিয়া- এ ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। হাতের মোবাইল থেকে মহাকাশের দৈত্যকার স্টেশন পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রে যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ফিচার যোগ হচ্ছে। মোবাইলের ইঞ্চি খানেক শরীরটার মধ্যে ঢুকে গেছে প্রজেক্টার আর স্ক্যানার মত বড় বড় যন্ত্রগুলো। যে কারণে যে কোনো জায়গা থেকেই যে কোনো তথ্য সহজেই আদান-প্রদান করা যাচ্ছে।

বর্তমানে ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে আপনি যে কোন দূরত্ব থেকে আপনার দুইয়ের অধিক বন্ধুদের সাথে গ্রুপ মিটিং করতে পারছেন। শুধুমাত্র আপনার কথা শুনেই আপনার কম্পিউটারের সকল কাজ সম্পন্ন সহ সারা পৃথিবী খুঁজে আপনার প্রয়োজনীয় তথ্যটি এনে দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন ভার্চুয়াল সহকারী। আপনি নিশ্চই অ্যাপলের সিরি, মাইক্রোসফটের কর্টানা, গুগলের গুগল অ্যাসিস্টেন্টের নাম শুনে থাকবেন। তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষের হাত ধরে এগুলো সবই আক্ষরিক অর্থেই স্বর্গীয় ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত করছে পৃথিবীকে।

৩/ অনলাইন বাণিজ্য ব্যবস্থা

যে কোনো জায়গায় থাকা গ্রাহককে তার প্রয়োজনীয় পণ্যটি দ্রুততার সাথে পৌছে দেয়াটা এখন ব্যবসায়ীক ফ্যাশন। ফিজিক্যাল পণ্যের পাশাপাশি ডিজিটাল পণ্যগুলো মার্কেটে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে। নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাবে তৈরী হচ্ছে নতুন প্রয়োজনীয়তা। যা জন্ম দিচ্ছে নতুন সেবার। যেমন অনলাইন স্বয়ংক্রিয় মার্কেটিং, ভিডিও বানানো, ফ্লাইট ও হোটেল বুকিং ইত্যাদি।

শুধু তাই নয়, আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমগুলোতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন বৈপ্লবিক প্রভাব ফেলছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। বিটকয়েনের মত ডিজিটাল মুদ্রার সাহায্যে দাতা এবং গ্রহীতা নিজেদের মধ্যে লেনদেন করতে পারছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তায়।

এমনকি, প্রযুক্তিগত সেবার কারণে জনবল ছাড়াই সম্পন্ন করা যাচ্ছে হাজার লোকের কাজ। যেমন:

সি আর এম (কাস্টমার রিলেশনশীপ ম্যানেজমেন্ট) এমন একটি অনলাইন সেবা, যেখানে আপনি পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে নতুন গ্রাহক বানানো থেকে শুরু করে পণ্য বিক্রি পর্যন্ত আপনার নিয়োগকৃত বিক্রয়কর্মীদের প্রতিটি কাজ দেখাশোনা করতে পারবেন।

এইচ আর আই এস (হিউম্যান রিসোর্চ ইনফরমেশন সিস্টেম) মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনার অনলাইন সেবা। এখানে আপনি নতুন কর্মচারী নিয়োগ থেকে শুরু করে কর্মচারীদের কর্মক্ষমতা নিরীক্ষা পর্যন্ত মানব সম্পদ বিভাগের প্রতিটি কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।

ডিস্টোপিয়ান ভবিষ্যতের আশঙ্কা

এবার চলুন, দেখে নিই, ইউটোপিয়া নাকি ডিস্টোপিয়া- এ দুয়ের মধ্যে ডিস্টোপিয়ান ভবিষ্যতের আশঙ্কা কেন থাকতে পারে।

১/ মহামারী রোগের সংক্রমণ

চিকিৎসা ক্ষেত্রে ক্রমান্বয়ে উন্নয়ন সাধিত হলেও থেমে নেই রোগের সংক্রমণ। যার কারণে বেড়েই চলছে মানুষের মৃত্যু হার। হুমকির মুখে পড়েছে জীবনের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল। সমসাময়িক সবথেকে বড় জটিলতা হচ্ছে করোনা সংক্রমণ, যা গত এক বছরে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে স্থবির করে দিয়েছে।

বিশ্ব জুড়ে প্রায় ২৭.৭ লক্ষ মানুষ মারা গেছে এই কোভিড-১৯ ভাইরাসে। এর আগে ২০০৫ থেকে ২০১৯ সালের দীর্ঘ পরিসরে এইচআইভি ভাইরাসে মারা গেছে মোট ৩৬০ লক্ষ লোক। আর করোনা ভাইরাসের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন অঞ্চলে কোভিড-১৯ এর পরিবর্তিত রূপ ধরা পড়ছে। যার কারণে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মানবজাতি।

২/ রাজনৈতিক অস্থিরতা

১৯৪৯ সালের ৮ জুনে প্রকাশিত ১৯৮৪ শিরোনামের ডিস্টোপিয়ান কথাসাহিত্যটিতে লেখক জর্জ ওরোয়েল এমন একটি ভবিষ্যতের কথা ব্যক্ত করেছেন, যেখানে সর্বগ্রাসীবাদের পীড়নে সামাজিক ব্যবস্থার অধঃপতন ঘটবে। উন্নত প্রযুক্তি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট অভিজাত মহলের দখলে থাকবে। ফলশ্রুতিতে স্বার্থের কারণে পারস্পরিক সংঘর্ষের রূপ হবে ভয়াবহ।

বর্তমান প্রেক্ষাপটটা যেন ঠিক এই সারাংশেরই প্রতিফলন। প্রতিটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ব্যক্তি থেকে শুরু করে একটি দেশের অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, বিনোদন, শিক্ষা প্রতিটি ক্ষেত্রেই উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। আর এই কারণেই অসুস্থ রাজনীতির বিষ ছড়িয়ে পড়ছে জনজীবনে। অতঃপর পারস্পরিক বিবাদ থেকে শুরু করে চূড়ান্তভাবে যুদ্ধ-বিগ্রহে জড়িয়ে পড়ছে দেশগুলো।

মার্কিন-ইরান উত্তেজনা, ভারত-চীনের সীমানা নিয়ে কোন্দল, সৌদি-ইয়েমেন সংঘর্ষ, সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, ইস্রায়েল-প্যালেস্টাইন সংঘর্ষ, ইউক্রেনের সংকট ইত্যাদি সহ বিভিন্ন দেশের শরণার্থী সংক্রান্ত পরিস্থিতিগুলো ধীরে ধীরে পুরো বিশ্বকে এক অনাকাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

৩/ মূল্যবোধের অবক্ষয়

এ কথা অনস্বীকার্য যে, প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণের পুরো পৃথিবীটা এখন সীমানা উপেক্ষা করে বিশাল এক গ্রামে পরিণত হয়েছে। কিন্তু গতিশীল জীবন ব্যবস্থায় পড়ে মানুষগুলো আবেগহীন যন্ত্রমানবে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। তাই বিবেচনাবোধের বিলুপ্তির কারণে প্রযু্ক্তির সদ্ব্যবহারের থেকে অসদ্ব্যবহার-ই বেশী হচ্ছে। ফলে সম্পর্কের ভাঙন, পারিবারিক জটিলতার সাথে সাথে হরহামেশাই চোখে পড়ছে প্রতারণা, হত্যা, নির্যাতন, ডাকাতি, দুর্নীতি। এমনকি অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থাগত দিক থেকে প্রবৃদ্ধিও ঐ নেতিবাচক প্রভাবগুলো রুখতে পারছে না।

ইউটোপিয়া নাকি ডিস্টোপিয়া! নিকটবর্তী ভবিষ্যতের দিক নির্দেশনা

উপরোক্ত পর্যালোচনার নিমিত্তে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলোর কোনটির সংখ্যা তুলনামুলকভাবে বেশী, তার উপর নির্ভর করে ইউটোপিয়া নাকি ডিস্টোপিয়া বিতর্কের ইতি টানা যায়। আর হ্যা প্রিয় পাঠক, এখানেই হচ্ছে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির অবতারণা। আপনার ইতিবাচকতা যুক্তিযুক্তভাবে খুঁজে বের করবে ভালো দিকগুলো। আর ঠিক একইভাবে আপনি যদি হতাশাবাদী হন, তাহলে আপনার যৌক্তিক মন খারাপ দিকগুলোকেই বেশী অগ্রাধিকার দিবে। কিন্তু খেয়াল রাখবেন, নৈরাশ্য ও হতাশা এক ধরণের রোগ। আর এ থেকে মুক্তি লাভেরও উপায় আছে। আর তা হচ্ছে সৃজনশীল কাজে নিবেদিত থাকা।

 

সর্বপরি ভেবে দেখুন, কিছু আশাবাদী মানুষের প্রচেষ্টার কারণেই কিন্তু আমরা এই ২০২১ সালে এসে পৌছেছি। তা নাহলে হয়ত অনেক আগেই এই বিশ্ব সংসারের ইতি ঘটতো। তাই নয় কি! এ ব্যাপারে আপনার মতামত আমাদের জানাতে পারেন। আর আর্টিকেলটি সোশ্যাল মিডিয়াতে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করে তাদেরকেও গঠনমূলক ও সৃজনশীল কাজের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে।

Similar Posts

One Comment

  1. ধন্যবাদ লেখাটির জন্য! এ বিষয়ে সামান্যই আইডিয়া ছিল, নতুন কিছু জানতে পারলাম।

Comments are closed.