আপনার সন্তানের ভাল আচরণকে কীভাবে উৎসাহিত করবেন

পিতা-মাতা হিসাবে সন্তানের প্রতি আমাদের দ্বায়িত্ব ও কর্তব্যের কোন অন্ত নাই। শিশুর আচরণে গঠনমূলক পরিবর্তন সাধন করে তাকে সামাজিক ভাবে গ্রহনযোগ্য রুপে গড়ে তোলা সকল পিতা-মাতারই একটি অন্যতম দ্বায়িত্ব। এটি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং বিষয় হলেও ব্যর্থতার কোন স্কোপ নাই। কারণ আপনার সন্তানের ভবিষ্যত সাফল্য অনেকাংশেই তার উত্তম ব্যবহারের উপর নির্ভরশীল।

একটি ইতিবাচক এবং গঠনমূলক পদ্ধতি হতে পারে আপনার সন্তানের আচরণের দিকনির্দেশনা প্রদানের সেরা উপায়। এর অর্থ হল যখন আপনার শিশু কোন অপছন্দনীয় আচরণ করবে তখন তাকে শাস্তি দিয়ে নয় বরং আপনার সন্তান ভাল আচরণ করলে তাকে প্রশংসা ও পুরস্কৃত করার মাধ্যমে উৎসাহিত করা।

এই ইতিবাচক পদ্ধতি কার্যকর করার জন্য এখানে কিছু ব্যবহারিক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে-

১) আপনার সন্তানকে গাইড করতে আপনার নিজস্ব আচরণ ব্যবহার করুন। আপনার সন্তান কীভাবে আচরণ করবে সে সম্পর্কে জানতে সে আপনাকে অনুসরণ করে এবং আপনার আচার-আচরণ কে অনুকরণ করে।
তার কাছে আপনি যা করেন তা আপনার কথার চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি চান আপনার সন্তান কোন কিছু চাওয়ার সময় “প্লিজ বা দয়া করে” শব্দটি ব্যবহার করুক, তাহলে আপনাকেও এই শব্দটি প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহার করতে হবে। আপনি যদি না চান যে আপনার শিশু উচ্চস্বরে কথা বলুক, তবে আপনাকেও নীরবে কথা বলতে হবে।

২) আপনার সন্তানকে বলুন, সে যখন খারাপ আচরণ করে তখন আপনি কেমন অনুভব করেন। যেমন, আপনি বলতে পারেন এত চেল্লাচিল্লির মাঝে আমি ফোনে কথা বলতে পারছি না। আমি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি। এটি আপনার শিশুকে আপনার দৃষ্টিকোণ থেকে জিনিসগুলি দেখার সুযোগ দেয়। এর ফলে আপনার বাচ্চা নিজেকে আপনার স্থানে রেখে ব্যাপারটি বোঝার চেষ্টা করবে এবং নিজের ব্যবহারকে আরো বেশি পরিমার্জিত করতে সচেষ্ট হবে।

৩) আপনার শিশু যখন আপনার পছন্দ মাফিক ভাল আচরণ করবে, তখন তাকে কিছু ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া করার মাধ্যমে উৎসাহিত করবেন। উদাহরণস্বরূপ, ‘বাহ, তুমি এত সুন্দর করে খেলছো। তুমি যেভাবে সমস্ত ব্লক টেবিলের উপরে রাখছো তা আমি সত্যিই পছন্দ করি। তারপর যদি সে ব্লক গুলো টেবিলের নিচে ফেলে দিতে থাকে, তখন তাকে থামতে বলুন। তাকে বোঝান এলোমেলো ব্লকগুলোর তুলনায় সাজানো ব্লকগুলো বেশি সুন্দর দেখাচ্ছিল। এমন করলে তার ভিতর সৌন্দর্য প্রীতির বিকাশ ঘটবে।

৪) আপনি নিজেকে আপনার সন্তানের স্তরে নামিয়ে আনুন। বাচ্চার সাথে বাচ্চাদের মত করে মতো মিশুন। তার সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করুন।
আপনি যখন আপনার সন্তানের সাথে ক্লোজ হবেন, তখন সে কি অনুভব করছে বা ভাবছে তা সম্পর্কে আপনি সম্যক ধারনা পাবেন।
আপনি যদি আপনার সন্তানের ঘনিষ্ঠ হতে পারেন তবে আপনি যে কথাই বলেন না কেন, সে আপনার কথার প্রতি আরও বেশি ফোকাস বা মনোযোগ দিবে। আপনার কথাগুলো মানার চেষ্টা করবে।

৫) অনেক সময় দেখা যায়, পিতা-মাতারা বাচ্চাদের কথার প্রতি ভ্রুক্ষেপ করছেন না। কিন্তু এমন করা একদমই ঠিক নয়। শিশুদের কোন কথা অবহেলা না করে তাদের সকল কথার প্রতি আমাদের মনোযোগী হতে হবে। বাচ্চার কথা বুঝতে না পারলেও সম্মতিসূচক মাথা নাড়ুন, এমনকি আপনার সন্তান যা বলছে তার পুনরাবৃত্তিও কর‍তে পারেন। আপনাদের মধ্যকার এধরনের আলাপ-চারিতা ছোট বাচ্চাকে হতাশার মতো উত্তেজনা এবং অন্যান্য আবেগগুলির সাথে লড়াই করতে সহায়তা করবে এবং অযাচিত আচরণ করা থেকে তাকে বিরত রাখবে।

৬) আপনার বাচ্চা ছোট হলেও তার ভিতরে কিন্তু বোধ শক্তি রয়েছে। তার কাছে করা সকল প্রতিশ্রুতি রক্ষা করার চেষ্টা করুন। আপনি যখন আপনার প্রতিশ্রুতিগুলি পুরণ করেন, আপনার শিশু আপনাকে বিশ্বাস করতে এবং সম্মান করতে শেখে। সে বুঝতে পারে যে, আপনি যখন কোন কিছুর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তখন আপনি তা অবশ্যই রাখবেন।
আপনার প্রতি তার এই দৃঢ় বিশ্বাসের কারনে যখন আপনি তাকে কোন কিছু মানা করবেন বা বোঝাতে চেষ্টা করবেন সে এই কথা গুলো মেনে চলতে আরো বেশি সচেষ্ট হবে।

৭) আপনার শিশুকে প্রত্যাশিত ও ভাল আচরণে উদ্বুদ্ধ করতে হলে আপনাকে অবশ্যই ভাল আচরণের জন্য একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে। আপনার সন্তানের চারপাশের পরিবেশ তার আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে। তাই আপনার বাচ্চাকে ভাল আচরণে সহায়তা করতে তার জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে পারেন। আপনার বাচ্চা যেসব জায়গায় ঘোরাঘুরি করে সেখানে তার যেন সে নিরাপদ থাকে তার জন্য সকল ব্যবস্থা গ্রহন করুন।
আপনার শিশু যে জিনিস গুলো ভাঙতে পারে বা সে জিনিস গুলোর মাধ্যমে আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে সেসব জিনিস তার ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখুন।

৮) কোন ব্যাপারে আপনার শিশুকে না বলার আগে নিজেকে শান্ত করুন। তার সাথে বিরুপ ব্যবহার করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। নিম্নস্বরে তাকে বুঝিয়ে বলুন। যদি তার পরেও তাকে বিরত রাখা না যায় তবে কোন প্রকার নেতিবাচক শব্দ ব্যবহার না করে সামান্য বকতে পারেন। বকার সময় তার বায়না কেন পূরণ যোগ্য নয় তা বুঝিয়ে বলুন।

৯) শিশুর সকল জেদ পূরণ করা উচিৎ নয়। এতে সে আরো বেশি জেদি হয়ে উঠবে। এজন্য যখন আপনার শিশু কোনও কিছুর জন্য জেদ করতে থাকে, আর আপনি যদি না বলে থাকেন, তবে আপনার সিদ্ধান্তে অটল থাকুন।

১০) যখন বাচ্চাকে কোন ব্যাপারে উপদেশ দিবেন তখন সহজবোধ্য ও সাবলীল ভাষা ব্যবহার করবেন। আপনি যদি সহজ ভাষায় সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেন তবে আপনার শিশু বুঝতে পারবে, তার কাছ থেকে আপনি কি প্রত্যাশা করেন এবং তাকে কোন বিশেষ অবস্থা বা পরিস্থিতিতে কেমন ব্যবহার করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, আমরা রাস্তা পার হওয়ার সময় আমার হাতটি ধরবে – এভাবে সহজ ভাষায় দিকনির্দেশনা দিলে সে রাস্তা পার হওয়ার সময় নিজেই আপনার হাত ধরবে।
মনে রাখবেন, ইতিবাচক নিয়মগুলি সাধারণত নেতিবাচক নিয়মের চেয়ে ভাল ও দ্রুত ফলাফল বয়ে আনে এবং আপনার সন্তানের আচরণকে ইতিবাচক উপায়ে পরিচালিত করে। উদাহরণস্বরূপ, “কখনও গেট খোলা রাখবে না”, না বলে “গেটটি বন্ধ কর” বলাটা অনেক শ্রেয়।

১১) বাচ্চার বয়স বৃদ্ধির সাথে দাথে তাকে কিছু দায়িত্ব দিন। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে দ্বায়িত্বটি যেন বয়স মাফিক হয়। দ্বায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে
তার পরিণতি অনুভব করার সুযোগও তাকে দিন। এটি করার ফলে আপনার সন্তান আরও বেশি দ্বায়িত্ববান হিসাবে গড়ে উঠবে। সব সময় বাচ্চাকে আগলে রাখলে সে পরনির্ভরশীল হয়ে পড়বে।
উদাহরণস্বরূপ, ধরুন আপনার বাচ্চা পিকনিকে যাচ্ছে এবং প্যাকিং এর দ্বায়িত্ব তার নিজের। অসতর্কতা বা অন্য কোন কারনে সে বালিশটি নিতে ভুলে যায় তবে তাকে রাতের জন্য বালিশ ছাড়া থাকতে দিন। তাকে বালিশ পৌছে দিতে যাবেন না। এরপর থেকে দেখবেন, আপনার শিশু দ্বায়িত্ব পালনে আরও বেশি যত্নশীল হবে।

১২) অনেক সময় দেখা যায় যে, পিতা-মাতা সন্তানকে আদেশ দিয়েই যাচ্ছে,কিন্তু তার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এই পরিস্থিতিতে পড়তে না চাইলে কোন আদেশ বা নিষেধ বারংবার করবেন না। আপনি যদি চান আপনার বাচ্চা কোন কাজ করুক বা বিরত থাকুক তাহলে তাকে এক থেকে দুইবারের বেশি বলতে যাবেন না। যদি তারপরও কোন ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া না পান তবে তাকে শেষ বারের মত সতর্ক করে দিন। তাকে একথাও জানিয়ে দিন যদি সে তার কথা না শোনে তাহলে পরিণতি কি হতে পারে। এছাড়া এক থেকে তিন পর্যন্ত গননা ও করতে পারেন তাকে সতর্ক করতে।

১৩) আপনার শিশুকে এমন অনুভব করান যেন সে নিজেকে পরিবারের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলে মনে করে।
আপনার বাচ্চাকে কিছু সাধারণ কাজ বা জিনিস দিন যার মাধ্যমে সে পরিবারকে সহায়তা করতে পারে। এর ফলে সে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ বোধ করবে।
পরিবারের বিভিন্ন ছোটখাটো সহজ কাজে তাকে সম্পৃক্ত করুন। এবং কিভাবে কাজটি সুচারু রুপে করা সম্ভব সে বিষয়ে তাকে প্রশিক্ষণ দিন। যখন সে ভুল ত্রুটি ছাড়াই কাজটি করতে সক্ষম হবে, তখন সে নিজের সম্পর্কে অনেক বেশি ভাল বোধ করবে এবং তার আত্মবিশ্বাস ও মনোবল অনেক বেশি দৃঢ় হবে। যখন আপনি তার আচরণ এবং প্রচেষ্টার জন্য তাকে প্রশংসা করেন তখন এটি তার আত্মমর্যাদাবোধ গঠনে সহায়তা করবে।

১৪) বাচ্চার দেখাশোনা করার সময় বিভিন্ন প্রকার চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। আপনি যদি এইসব চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতিগুলি সম্পর্কে আগে থেকে চিন্তা করেন তবে আপনি আপনার সন্তানের প্রয়োজনগুলি সম্পর্কে পূর্ব থেকেই পরিকল্পনা গ্রহন করতে পারবেন। কোন বিষয়ে আপনার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করার আগে তাকে পাঁচ মিনিটের সতর্কতা দিন। আপনার কেন তার সহযোগিতা দরকার তা নিয়ে তাঁর সাথে কথা বলুন। তারপরে দেখবেন আপনি যা প্রত্যাশা করেন তার জন্য সে প্রস্তুত থাকবে।

Similar Posts