আপনার জীবনের শত্রু EGO

আসুন, এখনই একটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখি। পরবর্তী পাঁচ সেকেন্ডের জন্য আপনি মনে মনে একদম চুপ থেকে একটাও কোনো কথা না বলে চেষ্টা করে দেখুন, দুঃখী অনুভব করতে পারেন কিনা? কি হলো, পারলেন না তো?

তো দুঃখী হওয়ার জন্য আগে মনে মনে কিছু বলাটা জরুরী। যেমন ধরুন,

‘দূর কিছু ভালো লাগছেনা, উফ একি মুশকিলে পড়লাম।’

এই ধরনের কিছু মনে মনে না বলে কখনো দুঃখী হওয়া সম্ভব না। এবার এখন তো আপনি জোর করে পাঁচ সেকেন্ডের জন্য অনেক কষ্টে নিজের মনকে চুপ করিয়ে রাখলেন, কিন্তু ভাবুন তো, এই একই জিনিসটা যদি আপনি যখন ইচ্ছা যতক্ষণের জন্য ইচ্ছা করতে পারেন, তাহলে তখন কি আপনার জীবনে দুঃখ বলে কিছু তৈরি হওয়ার জায়গা থাকবে? কিন্তু সেটা করা কিভাবে সম্ভব?

সেটাই আজ আপনার সাথে DAN HARRIS এর লেখা বেস্ট সেলিং বুক, 10% HAPPIER থেকে শেয়ার করব।

আপনার EGO অর্থাৎ অহংকারই হলো আপনার সব থেকে বড় শত্রু

EGO অর্থাৎ অহংকার বলতে আমরা সাধারণত বুঝি স্বার্থপরতা করা বা গর্ববোধ করা এই জাতীয় কিছু। কিন্তু  DAN HARRIS তার বইতে অহংকার বলতে বুঝিয়েছেন, THE VOICE IN OUR HEAD অর্থাৎ সারাদিন ধরে মনের মধ্যে অবিরাম আমরা যে বকবক করে চলি, সেটাকে তিনি EGO অর্থাৎ অহংকার বলেছেন।

সকালে চোখ মেলে উঠার পর থেকে শুরু করে রাতে শুতে যাওয়া অবধি, এই ভাঙ্গা টেপরেকর্ডারটা সারাদিন আমাদের মনের মধ্যে অনবরত বেজে চলে। এটাকে ভাঙ্গা টেপরেকর্ডার বলছি, কারণ একটু লক্ষ করলেই আপনিও দেখতে পাবেন এই একই কথা প্রতিদিন গাধার মত সমাপ্তিহীন ভাবে রিপিট করতে থাকে। আর দুঃখের বিষয় হল, এর কথা মতোই আমরা সারাদিন প্রতিটা কাজ করি। চুপচাপ হয়তো একটু বসে আছেন, হঠাৎই মনের ভেতর থেকে আওয়াজ আসলো, কি বসে বসে অসহ্য হয়ে যাচ্ছি, একটু ফেইসবুকটা খুলে দেখি। আর সাথে সাথে আপনি ফোনটা হাতে তুলে নিলেন। অথবা অফিস থেকে ফিরে আপনি হয়তো ফিজিক্যালি অতটাও ক্লান্ত না, কিন্তু মনের ভেতর থেকে আওয়াজ আসলো, না আজ খুব ক্লান্ত লাগছে, আজ আর জিমে যাব না।

আজকে আবার ওই সিরিয়ালটার বিশেষ মহা পর্বটাও তো দেখতে হবে। ব্যাস আপনি টিভি চালিয়ে বসে পড়লেন। আমি যদি আপনাকে বলি, এখনই মোবাইলটা খুলে ফেইসবুকটা চেক করুন। আপনি আমার কথাটা শোনামাত্র সেটাকে বিচার করতে শুরু করবেন, যে আমি কেন বলছি, আমার এর পিছনে কি মতলব থাকতে পারে বা আপনার কি আমার কথা মত কাজটা করা ঠিক হবে? ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই একই কথাটা যদি আপনার নিজের মনের ভেতর আপনার EGO আপনাকে বলে, তখন আপনি কোনোরকম কোনো বিচার না করেই সেটা করতে শুরু করে দেবেন।

তো আসল সমস্যাটা হল, আপনি নিজের EGO’র সাথে নিজেকে আইডেন্টিফাই করে নিয়েছেন। অর্থাৎ আপনি মনে করেন আপনার EGO’ই হলেন আপনি। ফলে আপনার EGO আপনাকে যেটা করতে বলে সেটাকে আপনি কোনো রকম বিচার না করেই মেনে নেন। কারণ আপনি মনে করেন আপনি নিজের মত অনুযায়ী কাজ করছেন। যেটা সম্পূর্ণ একটা মায়ার জাল।

আপনি নিজেই ভেবে দেখুন না, যদি সত্যিই আপনি আপনার EGO অর্থাৎ মনের ভিতরের আওয়াজটা হতেন, তাহলে গভীর ঘুমের সময় যখন সেই আওয়াজটার কোনো অস্তিত্ব থাকেনা না, তখন আপনি কি করে প্রেজেন্ট থাকতেন। ঘুম থেকে ওঠার পর আপনি কি করে জানতেন, যে আপনি একটু আগে গভীর ঘুমের মধ্যে আচ্ছন্ন ছিলেন। সেই আওয়াজটা মরে যাওয়ার সাথে সাথে আপনারও মরে যাওয়ার কথা। কিন্তু এই আর্টিকেলের শুরুতেও পাঁচ সেকেন্ডের জন্য সেই আওয়াজটা মরে গিয়েছিল। কিন্তু আপনি তো বেঁচে ছিলেন। তাই সবার আগে এই মায়ার জাল থেকে আপনাকে নিজেকে বের করে আনতে হবে। নতুবা এই আধপাগল EGO’র কথা মত যদি আপনি সবসময় চলতে থাকেন তাহলে আপনার বিপদ নিশ্চিত।

আপনার অহংকার কখনো সন্তুষ্ট হয় না

আজকে যদি আপনার প্রোফাইল পিকচারে পঞ্চাশটা লাইক আসে, তাহলে এরপরের দিন প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করলে আপনার EGO’র সেটায় ষাটটা লাইক চায়। এবার মনে করুন, পরদিন যদি আপনি ষাটটা লাইক পেয়েও যান, তাতে কি আপনার EGO চিরকালের মতো সন্তুষ্ট হয়ে যায়, নাকি তারপরের দিন ওর সত্তরটা লাইক চায়। আর যদি বাই চান্স তারপরের দিন সত্তরটার বদলে উল্টে লাইক কমে গিয়ে মাত্র পঁয়তাল্লিশটা লাইক পড়ে, ব্যাস তাহলে সাথে সাথে উল্টাপাল্টা বকবক শুরু।

‘আমি মনে হয় আগের থেকে দেখতে খারাপ হয়ে যাচ্ছি। দূর আমাকে তো কেউ পছন্দই করেনা।’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

EGO যেটা চায়, সেটা যদি ও পায় তাহলে কয়েক মুহূর্তের জন্য হয়তো ও খুশি হয়, আর তারপর সাথে সাথে নতুন আরেকটা আরো উঁচু নিশানা স্থাপন করে সেটাকে পাওয়ার জন্য ছটফট করতে শুরু করে দেয়। অর্থাৎ যখন আপনি EGO’র সাথে নিজেকে আইডেন্টিফাই করে জীবনে বেঁচে থাকার পথকে বেছে নেন, তখন আপনার জীবনে খুশি, আনন্দ এগুলো ডুমুরের ফুলের মত ক্ষণিকের বিরল ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়। আর ছটফটানি, অশান্তি, দুঃখ এগুলো প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়।

আত্মসচেতনতাই হলো অহংকারের মায়াজাল থেকে মুক্তি পাওয়ার একমাত্র উপায়

বাসস্টপে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছেন, হঠাৎই আপনার EGO বলে উঠলো,

‘না, আজ সারাদিন প্রচুর ধকল গেলো, এই ফাঁকে চট করে একটা সিগারেট  টেনে নেই’

যদি আপনি আত্মসচেতন না হন, অর্থাৎ যদি আপনি নিজের মাথার ভিতরের আওয়াজটাকেই নিজের মতামত বলে মেনে নেন, তাহলে আপনি কখনো বিচারও করবেন না, যে আপনার সিগারেটটা ধরানো উচিত হবে কিনা? কিন্তু যদি আপনি আত্মসচেতন হন, তাহলে সিগারেট ধরানোর জন্য আপনি যে ছটফটানি অনুভব করছেন সেটাকে লক্ষ্য করতে পারবেন। কাজটা করা আপনার শরীরের জন্য আদৌ ঠিক হবে কিনা? সেটা বিচার করতে পারবেন। আর তারপরেও যদি আপনি সেই ছটফটানির কাছে হার মেনে নিয়ে ফাইনালি সিগারেটটা মুখে তুলেও নেন, তবে আপনি এটা জানবেন, যে আপনি এটা করে নিজের ক্ষতি করলেন।

কিন্তু যদি আপনি আত্মসচেতন না হন, তবে সিগারেটটা ধরিয়ে শেষ করে মাটিতে ফেলে দেওয়ার পরও আপনি এটা জানবেনই না, যে এইমাত্র আপনি নিজের ক্ষতি করলেন। এটাই আত্মসচেতন থাকা আর না থাকার মধ্যে সবচেয়ে বড় তফাৎ। কারণ সচেতনভাবে আপনি দীর্ঘদিন ধরে কখনো নিজের ক্ষতি করে চলতে পারবেন না। একটা সময় পর সেই সচেতনতা ওই ছটফটানির পাওয়ারকে ওভার পাওয়ার করে যাবেই। তখন অহংকারের মায়া আর আপনার উপর কর্তৃত্ব ফলাতে পারবে না।

মজার বিষয় হলো, যখন আপনি EGO’র মায়ার কবলে থাকেন, সেই সময় সিগারেটটা ধরিয়ে সম্পূর্ণ শেষ করে ফেলে দেওয়ার পরও আপনার কখনো এটা মনে হয় না, যে আপনি এইমাত্র নিজের ক্ষতি করলেন। তার কারণ EGO কখনো আপনার সচেতনতাকে বর্তমান মুহূর্তে থাকতে দেয় না। অতীত বা ভবিষ্যতের ব্যপারে অনর্গল বকে চলার মাধ্যমে আপনার EGO চালাকি করে আপনার সচেতনতাকে বর্তমান থেকে সরিয়ে অতীত বা ভবিষ্যতে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে।

উদাহরণস্বরূপ: সিগারেট খেতে খেতে আপনি সারাদিনে আজ আপনার সাথে কি কি খারাপ হয়েছে সেগুলো নিয়ে ভাবতে এতটাই ব্যস্ত হয়ে উঠেন, যে এখন যে আপনি সিগারেট মুখে নিচ্ছেন, সেদিকে আপনার কোনো ধ্যান বা সচেতনতাই থাকেনা। সম্পূর্ণ অসচেতনভাবে আপনি টানতে থাকেন। তাই নিজের ধ্যান অর্থাৎ সচেতনতাকে যত বেশি আপনি বর্তমান মুহূর্তে ধরে রাখতে পারবেন, ততবেশি আপনার EGO অর্থাৎ অহংকার দুর্বল হয়ে পড়বে। আর ওর মায়াজাল থেকে আপনি বেরিয়ে আসতে পারবেন।

 

যেমন এই বইয়ের অথার DAN HARRIS বলেছেন,

“WHEN YOU HAVE ONE FOOT IN THE FUTURE AND THE OTHER IN THE PAST, YOU PISS ON THE PRESENT.”

অর্থাৎ,

“যখন আপনার একটা পা ভবিষ্যতে, আরেকটা পা অতীতে দিয়ে আপনি দাঁড়িয়ে থাকেন, তখন বর্তমানের ওপর আপনি মূত্র বিসর্জন করতে শুরু করেন।”

Similar Posts

4 Comments

  1. পড়ে খুবই ভালো লাগলো ভাই ।
    লাস্টের কোটটা বেশি ভাল্লাগলো ।
    WHEN YOU HAVE ONE FOOT IN THE FUTURE AND THE OTHER IN THE PAST, YOU PISS ON THE PRESENT.✌✌✌

  2. WHEN YOU HAVE ONE FOOT IN THE FUTURE AND THE OTHER IN THE PAST, YOU PISS ON THE PRESENT.”

    অর্থাৎ,

    “যখন আপনার একটা পা ভবিষ্যতে, আরেকটা পা অতীতে দিয়ে আপনি দাঁড়িয়ে থাকেন, তখন বর্তমানের ওপর আপনি মূত্র বিসর্জন করতে শুরু করেন।”

    কথাটা অনেক ভালো লেগেছে

Comments are closed.