অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন ( পর্ব ৪ )
অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধঃপতনের সূচনা:
সুলতান সুলেমানের শাসনের সমাপ্তি লগ্নে অটোম্যান সাম্রাজ্য বিস্তৃতির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়। এই সময় তা তিন মহাদেশ ব্যাপী বিস্তৃত ছিল। অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতন মূলত সুলতান সুলেমান এর পর থেকেই শুরু হয়। তিনি নিজে যোগ্য শাসক হলেও তিনি তার যোগ্য উত্তরসুরি রেখে যেতে পারেননি। সুলতান সুলেমানের মৃত্যুর পর এই সাম্রাজ্যে যোগ্য শাসকের অভাবে দিন দিন জৌলুস হারাতে থাকে।
তার ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে যোগ্য ছিলেন শাহজাদা মুস্তাফা ও শাহজাদা বায়েজিদ। কিন্তু তিনি তার দুই যোগ্য সন্তানকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ফলে একমাত্র উত্তরসূরি শাহজাদা সেলিম সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু তিনি প্রায় সময় প্রাসাদে মদ্যপ অবস্থায় থাকতেন এবং কবিতা লিখে সময় কাটাতেন। এভাবে তার পরবর্তী কয়েক জন শাসক একইভাবে প্রাসাদকেন্দ্রিক জীবনযাপন করতেন, যুদ্ধে ছিল তাদের চরম অনীহা। অযোগ্য সন্তান, অযোগ্য উজিরে আজম,দুর্নীতি পরায়ণ সরকারি অফিসার, বিশ্বাসঘাতক মিত্রদের কারণে অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতন দিন দিন ত্বরান্বিত হতে থাকে। ১২৯৯ সাল থেকে ১৫৬৬ সাল পর্যন্ত শাসকের মধ্যে কোনো অযোগ্য শাসক ছিলেন না, অন্যদিকে ১৫৬৬ সাল থেকে ১৯২২ পর্যন্ত তের জন সুলতানের মধ্যে মাত্র দুইজন দক্ষ শাসক ছিলেন।
সুলতান মুরাদ (৪র্থ) ১৬২৩ সালে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে তরুণ হয়েও রাষ্ট্রপরিচালনায় অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দেন। সুলতান চতুর্থ মুরাদ তার শাসনামলে কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব জোরদার করেন। অতি অল্প সময়ে ঘুষ,দুর্নীতি,লুটপাট,বৈষম্য দূর করে রাজ্যের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনেন। ১৬৩৯ সালে সুলতান চতুর্থ মুরাদ সাফাভীদের নিকট হতে বাগদাদ পুনরুদ্ধার করেন। ১৬৪০ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৬৮৩ সালে সুলতান চতুর্থ মুহাম্মদ এর শাসনামলে অটোম্যান সেনাপতি কারা মোস্তফা প্রায় ৩ লক্ষ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে ইউরোপের গোল্ডেন এ্যাপল খ্যাত অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা আক্রমণ করেন। অটোম্যান সেনাপতি কারা মোস্তফা এই যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে পলায়ন করেন।এ অভিযানটি ব্যর্থ হওয়ায় ইউরোপে উসমানীয় সাম্রাজ্যের প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যাপকভাবে হ্রাস পায়। এসময় অটোম্যান সাম্রাজ্য একদিকে যেমন ধর্মীয় দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে, অন্যদিকে দীর্ঘকালব্যাপী সামরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার দিক থেকেও ইউরোপীয়দের থেকে পিছিয়ে পড়ে। ফলে তারা একের পর এক যুদ্ধে খ্রিষ্টানদের কাছে পরাজিত হয়ে ইউরোপ ও আফ্রিকার রাজ্যগুলো হারাতে থাকে।
১৬৯৯ সালে জেনটা যুদ্ধে পরাজয়ের পর কারলুইজ চুক্তির ভিত্তিতে মধ্য ইউরোপ অটোম্যানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ১৭৭৪ সালে রাশিয়ার সাথে কজলুঝা যুদ্ধে পরাজয়ের পর কুচুক কেনারজি চুক্তির ফলে ক্রিমিয়ান খানাত হাতছাড়া হয়। ১৮১৭ সালে বেলগ্রেড সহ ইউরোপের বিস্তীর্ণ অঞ্চল অটোম্যানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। ১৮৩০ সালে আলজেরীয় উপকূলে ফরাসি বাহিনীর অবতরণ ঘটে এবং দখলদারিত্বের সূচনা হয়। ১৮৩২ সালে অটোমান সাম্রাজ্য হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গ্রিস স্বাধীনতা লাভ করে। ১৮৭৮ সালে রাশিয়ার সাথে বার্লিন চুক্তির ফলে রোমানিয়া,মন্টিনিগ্রো ও সার্বিয়া অটোম্যানদের হাতছাড়া হয়ে যায়। একই বছরেই বসনিয়া ও হারজেগোভিনা স্থানীয়ভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ১৮৮১ সালে বারদো চুক্তির ফলে তিউনেশিয়া ফ্রান্সের কর্তৃত্বে চলে যায়। ১৮৮২ সালে ব্রিটিশরা মিশর শহর দখল করে নিলে স্থায়ীভাবে তা অটোম্যানদের কর্তৃত্ব থেকে বেরিয়ে যায়। ১৯১২ সালে ইতালির সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে প্রথম লুজেন চুক্তির ফলে লিবিয়া হাতছাড়া হয়। ১৯১৭ সালে প্রথম বলকান যুদ্ধে গ্রিস ও বুলগেরিয়ার কাছে ইউরোপের রাজ্যগুলো হারায়।
১ম পর্ব- অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ১)
২য় পর্ব- অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ২)
৩য় পর্ব- অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ৩)
৫ম পর্ব- অটোম্যান সাম্রাজ্যের উত্থান পতন (পর্ব ৫)
শেষের দিকে যেভাবে সব হাতছাড়া হচ্ছে,ভাবতেই কেমন খারাপ লাগে
যোগ্য উত্তরসূরি বাছাইয়ে ভুল হলে যা হয়