ফার্স্ট বেঞ্চার কর্মচারী এবং লাস্ট বেঞ্চার মালিক কিভাবে?

আমাদের এডুকেশন সিস্টেম অনুযায়ী ছোটবেলা থেকেই স্কুলে আমাদের ইতিহাস, ভূগোল, পরিবেশ পরিচয়, গুষ্টির পিন্ডি সমস্ত কিছু শেখানো হলেও জীবনে চলার জন্য সব থেকে জরুরি যে জিনিসটা সেই টাকার ব্যাপারে কোনো কিছুই শেখানো হয় না। স্কুলগুলোর প্রধান লক্ষ্য ছাত্র-ছাত্রীদের শেখানো কিভাবে একটা চাকরি জোগাড় করা যায়। কখনো এটা শেখানো হচ্ছে না যে নিজের একটা কোম্পানি খুলে কিভাবে লোকেদের চাকরি দেওয়া যায়। ফাইনান্সিয়াল এডুকেশনের বেসিকটুকু যে কত ধরনের ইনকাম হতে পারে সেটুকু নিয়ে পর্যন্ত কখনো কোথাও আলোচনা হয় না। নাই স্কুল কলেজে আর নাইবা বাড়িতে। তাই আপাতত, আমাদের নিজেদেরকে ফাইনান্সিয়াল এডুকেশনের ইম্পর্টেন্সটা বুঝে সেটা নিজের তাগিদে শিখতে হবে। তো চলুন শিখে নেওয়া যাক।

বিলগেটস একবার বলেছিলেন,

পরীক্ষায় কিছু সাবজেক্টে আমি ফেল করে যেতাম। কিন্তু আমার বন্ধু সবকটা সাবজেক্টে পাশ করে যেত। এখন আমার সেই বন্ধু মাইক্রোসফট-এ একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করে। আর আমি এখন মাইক্রোসফট-এর মালিক।

এমনকি ডক্টর এপিজে আবদুল কালামও বলেছিলেন,

দেশের সব থেকে বড় ব্রেইনি মাথা হয়তো কোনো ক্লাসরুমের শেষ বেঞ্চে পাওয়া যেতে পারে।

তো এনাদের এরকম বলার প্রকৃত অর্থ কি? সেটাই আজ রবার্ট কিয়োসাকি (ROBERT KIYOSAKI) এর লেখা WHY “A” STUDENTS WORK FOR “C” STUDENTS AND “B” STUDENTS WORK FOR THE GOVERNMENT বই থেকে আপনার সঙ্গে শেয়ার করব।

 

১. তিন ধরনের ইনকামের মধ্যে তফাতটা বুঝতে শিখুন

টাকা রোজগার করার যত রকমের উপায় হতে পারে সেই সবগুলোকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায়।

  • অর্ডিনারি,
  • পোর্টফলিও,
  • প্যাসিভ ইনকাম।

এরমধ্যে অর্ডিনারি ইনকাম বলতে বোঝায়, নিজে কাজ করে তার পরিবর্তে টাকা রোজগার করা। মানে যেমন কোনো কোম্পানিতে চাকরি করা বা নিজের একটা ছোট দোকান চালানো। সারা জীবন একটা ফিক্সড বা ভীষণই লিমিটেড ইনকাম আর সারা জীবন টাকা রোজগারের চিন্তায় নিরন্তন পরিশ্রম করে চলা। যেটার জন্য স্কুল-কলেজগুলোতে স্টুডেন্টদেরকে তৈরি করা হয়। তাই স্বাভাবিক বেশিরভাগ লোক এই ইনকামের পথটাকেই বেছে নেয়। আর জীবনে কখনো ফাইনান্সিয়াল ইন্ডিপেন্ডেন্স হাসিল করে উঠতে পারে না। ফাইন্যান্সিয়াল ইন্ডিপেন্ডেন্স হাসিল করা মানে, যখন আপনাকে আর টাকা রোজগার করার জন্য কোনো কাজ করার দরকার পড়ে না।

পরবর্তী পোর্টফোলিও ইনকাম বলতে বোঝায়, নিজের টাকাকে কাজে লাগিয়ে টাকা রোজগার করা। অর্থাৎ, যেমন শেয়ার মার্কেটে ইনভেস্ট করা এটা অর্ডিনারি ইনকামের তুলনায় অনেকগুণে ভালো একটা উপায় কিন্তু ঝুঁকি ভীষণ উঁচু থাকায় এটাকে বেস্ট উপায় বলা চলে না। আর তাছাড়া এই পদ্ধতিতেও ফাইন্যান্সিয়াল ইন্ডিপেন্ডেন্স হাসিল করতে বহু বছর সময় লেগে যায়।

অথারের মতে, টাকা ইনকাম করার বেস্ট উপায় হল প্যাসিভ ইনকাম। প্যাসিভ ইনকাম বলতে বোঝায়, নিজের সম্পত্তিগুলোকে কাজে লাগিয়ে টাকা রোজগার করা। সম্পত্তি বলতে এরকম কোনো জিনিসকে বোঝায়, যেটা থেকে সবসময় মাস গেলেই আপনার পকেটে টাকা ঢুকে। যেমন কাউকে বাড়ি ভাড়া দিলে সেখান থেকে যে টাকা রোজগার হয় বা বড় বড় বিজনেস যেমন কেএফসি, অ্যামাজন, ফেসবুক এই সমস্ত কোম্পানির মালিকরা যদি কয়েক মাসের জন্য ছুটিতেও কোথাও ঘুরতে চলে যান, তাদের পকেটে তখনও সমানভাবে টাকা ঢুকতে থাকে। তাই ফাইনান্সিয়াল ইন্ডিপেন্ডেন্স হাসিল করার জন্য, এই ইনকামের উপায়টাই সবথেকে বেস্ট উপায়।

 

২. নিজের প্রফেশন বেছে নেওয়ার আগে ক্যাশ ফ্লো কোয়াড্রেন্টে নিজের পজিশনটা বেছে নেওয়া বেশি প্রয়োজন

টাকা রোজগার করার যত ধরনের পেশা আছে সেগুলোকে ক্যাশ ফ্লো কোয়াড্রেন্টে চার ভাগে ভাগ করা হয়।

 

এ ক্যাশ ফ্লো কোয়াড্রেন্টে বাম পাশে রয়েছে ‘E’ এবং ‘S’ ক্যাটাগরি।

‘E’ স্ট্যান্ড ফর Employee

এনাদের কাছে সবচেয়ে জরুরি জিনিস হল সিকিউরিটি। এনাদের যদি সবচেয়ে বেশি টাকা ইনকাম করার প্রয়োজন বোধ হয়, তাহলে এনারা খুব বেশি হলে আরেকটু বেশি মাইনের চাকরি খোঁজার কষ্টটুকু করেন। এনাদের কাছে শিক্ষার অর্থ হলো কোনো একটা জিনিসে স্পেশালিস্ট হয়ে মোটা মাইনের একটা কোনো চাকরি জোগাড় করা।

‘S’ স্ট্যান্ড ফর Self-employed

ইনারা ঝুঁকি নিতে অতটাও ভয় পান না তাই ইনারা নিজে নিজের বস হয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। কিন্তু ইনাদের মধ্যে একটা অ্যাটিটিউড কাজ করে যে তিনি যে কাজটা করছেন সেটা তার থেকে বেটার অন্য কেউ করতে পারে না। ফলে, এনারা অন্য কাউকে নিজের আন্ডারে হায়ারও করতে চান না। একা একা নিজে যতটুকু সময় কাজ করেন তার বদলে যেটুকু রোজগার হয় সেটুকুতেই ইনাদের ইনকাম সীমাবদ্ধ থাকে। যেমন ধরুন, কোনো ডক্টর, লয়ার বা ফ্রিল্যান্সার।

 

আর এই ক্যাশ ফ্লো কোয়াড্রেন্টে ডান পাশে রয়েছে ‘B’ এবং ‘I’ ক্যাটাগরি।

‘B’ স্ট্যান্ড ফর Business owner

এনারা Employee এবং Self-employed-দের কাজে লাগিয়ে তাদেরকে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়ে নিজের বিজনেসটাকে সম্পূর্ণ একটা সিস্টেমের মধ্যে ফেলে অটোপাইলট মোডে নিয়ে চলে আসে। ফলে, “S” ক্যাটাগরির মতো এনারা যেটুকু সময় কাজ করেন শুধু সেটুকু সময়ের জন্য আয় করেন না বরং কাজ না করলেও ইনাদের সারাক্ষণ আয় হতেই থাকে।

‘I’ স্ট্যান্ড ফর Investor

ইনারা হলেন সবথেকে বেশি চালাক। ইনারা Business owner-দের কাজে লাগিয়ে নিজেরা অলমোস্ট জিরো কাজ করে, সারাক্ষণ টাকা আয় করতে থাকেন। ইনারা নিজের বা এমনকি কখনো কখনো অন্যের টাকা নিয়ে সেটা Business owner-দের তৈরি করা বিজনেসে ইনভেস্ট করে সম্পূর্ণ হাতের উপর হাত গুটিয়ে বসে থেকে সারাক্ষণ টাকা আয় করতে থাকেন। বিজনেস অনারদের তাও এমপ্লয়ীদের ম্যানেজ করার কাজটুকু করতে হয়, ইনভেস্টরদের সেটুকু করারও দরকার পড়ে না। উপর থেকে দেখে মনে হয় এমপ্লয়ীরা সবথেকে বেশি সিকিওর থাকে, আর ইনভেস্টররা সবথেকে বেশি ঝুঁকিতে। কিন্তু বাস্তবে, ইমপ্লয়ীরা সবথেকে বেশি ঝুঁকিতে থাকে আর ইনভেস্টররা সব থেকে বেশি সিকিওর। কারণ, এমপ্লয়ীদের নিজেদের ইনকামের উপর কন্ট্রোল সবথেকে কম থাকে। আর ইনভেস্টরদের সবথেকে বেশি। একজন এমপ্লয়ীকে একজন বিজনেস অনার নিজের ইচ্ছামত যখন ইচ্ছা কাজ থেকে বের করে দিতে পারে, এতে তখন সেই এমপ্লয়ীর ইনকাম টোটালি জিরো হয়ে যাবে। কিন্তু একজন ইনভেস্টরের কাছে সবসময় ইনভেস্ট করার জন্য হাজারখানা অপশন ওপেন থাকে।

তো ক্যাশ ফ্লো কোয়াড্রেন্টে আপনি কোন ক্যাটাগরিটাকে নিজের প্রফেশন হিসেবে বেশি বেছে নিবেন?

 

৩. একটা জিনিসে ভীষণভাবে পারদর্শী হাওয়ার থেকে অনেক জিনিসে অল্প পারদর্শী হওয়াটা বেশি ভালো

 

 

আমাদের এডুকেশন সিস্টেমটা এমনভাবে ডিজাইন করা, যেখান থেকে কোনো স্টুডেন্ট একটা কোনো পার্টিকুলার বিষয়ে স্পেশালিস্ট বেরোয়। কেউ ম্যাথে অনার্স, তো কেউ Chartered Accountant-এ, তো কেউ আবার ডেন্টিস্ট। ফলে, পড়াশোনা শেষ করে বেরিয়ে এদের কাছে দুটোই অপশন থাকে, হয় Employee নতুবা Self-employed হয়ে জীবিকা নির্বাহ করা। ফলে এডুকেশন সিস্টেম অনুযায়ী বেস্ট স্টুডেন্টরা অর্থাৎ ‘A’ গ্রেড স্টুডেন্টরা মানে যারা ফার্স্ট বেঞ্চে বসে, তাদের বাকি জীবনটা হয় Employee অথবা Self-employed থেকে কেটে যায়।

কিন্তু এই এডুকেশন সিস্টেম অনুযায়ী, যারা খারাপ স্টুডেন্ট অর্থাৎ যারা ‘C’ গ্রেড স্টুডেন্ট মানে যারা লাস্ট বেঞ্চে বসে, তারা এডুকেশন সিস্টেম অনুযায়ী কোনো একটা পার্টিকুলার বিষয়ে স্পেশালিস্ট না হয়ে বরং সেটার বাইরেও লাইফের সমস্ত দিকে অল্প অল্প করে পারদর্শী হয়ে ওঠে। আর একজন সফল বিজনেস অনার বা ইনভেস্টর হয়ে ওঠার জন্য শুধু একটা বিষয়ে জ্ঞান থাকা যথেষ্ট না। কেউ যদি হিসাব কিতাব খুব ভালো পারে কিন্তু লোকের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় সেটা যদি একদমই না জানে, তাহলে তার পক্ষে একজন সফল বিজনেস অনার হওয়া কোনোদিন সম্ভব না। তাই লাস্ট বেঞ্চেররা কোম্পানির মালিক হয়ে ওঠে। আর ফার্স্ট বেঞ্চেররা তাদের কোম্পানিতে চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করে।

আর যারা মাধ্যমিক স্টুডেন্ট অর্থাৎ ‘B’ গ্রেড স্টুডেন্ট মানে যারা একটা বিষয়ে হালকা স্পেশালিস্ট কিন্তু সাথে অন্যান্য কয়েকটা দিকেও একটু একটু জ্ঞান রাখে, তারা সাধারণত গভারমেন্ট এমপ্লয়ী হয়ে জীবিকা নির্বাহ করে।

স্যার আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন,

কেউ স্কুলের বই পড়ে যা কিছু শিখে, সে সবকিছু ভুলে যাওয়ার পর তার ভিতরে যা পড়ে থাকে, সেটাই হলো তার প্রকৃত শিক্ষা।

Similar Posts