বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন যারা ( ১ম পর্ব )

উপরাষ্ট্রপতি পদটি বর্তমান প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অচেনা। অথচ একসময় “ভাবী রাষ্ট্রপতি” আর প্রচন্ড ক্ষমতার কারণে এ পদটি ছিলো সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু। বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ ছিলো উপরাষ্ট্রপতি। রাষ্ট্রপতির মৃত্যু, অপসারণ ও পদত্যাগের ফলে তিনি পদাধিকারবলে পালন করতেন রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব। মহামান্য রাষ্ট্রপতি তার পছন্দের ব্যক্তিকে এ পদে নিয়োগ দিতেন। রাষ্ট্রীয় ভবন যমুনায় (হেয়ার রোড, রমনা, ঢাকা) ছিলো উপরাষ্ট্রপতির বাসভবন।

the-vice-presidents-of-bangladesh

মুজিবনগর সরকার সর্বপ্রথম উপরাষ্ট্রপতি পদটি সৃষ্টি করে। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সংসদীয় সরকারব্যবস্থা চালু হলে এ পদটি বিলুপ্ত হয়। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বাকশাল গঠিত হলে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকারের সাথে ফিরে উপরাষ্ট্রপতি পদ। মোশতাক সরকারের পতনের পর এ পদ আবারও বিলুপ্ত হয়। ফের এ পদটি পুনর্জীবিত করা হয় ১৯৭৭ সালে। ১৯৮২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর এ পদটি বাতিল করা হলেও ১৯৮৬ সালে তা আবার পুনঃস্থাপিত হয়। অবশেষে সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনীর ফলে এ পদটির চূড়ান্ত বিলোপ ঘটে। ১৯৯১ সালের ৯ অক্টোবর সর্বশেষ উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ তার মেয়াদ শেষ করেন।

১৯৭১ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত মোট ৭ জন ব্যক্তি বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

 

সৈয়দ নজরুল ইসলাম (১৯২৫-১৯৭৫)

syed_nazrul_islam

জাতীয় চার নেতার অন্যতম সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুরোটা জীবনই কেটেছে রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে। ১৯৫৭ সালে তিনি বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়কালে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে বিভিন্ন সময় তিনি ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। মুজিবনগর সরকার তাকে বাংলাদেশের প্রথম উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করে। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের পর নতুন মন্ত্রিসভায় তিনি পান শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। পাশাপাশি জাতীয় সংসদের উপনেতার দায়িত্বও দেওয়া হয় তাকে। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলে তিনি দ্বিতীয় বারের মতো দেশের উপরাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ লাভ করেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার শোকাবহ সময়ে যেখানে সাংবিধানিকভাবে তার রাষ্ট্রপতি হওয়ার কথা, সেখানে তিনি নিক্ষিপ্ত হন কারাগারে। কারাগারেই ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

মোহাম্মদ উল্লাহ (১৯২১-১৯৯৯)

মোহাম্মদউল্লাহ

মোহাম্মদ উল্লাহ-ই বাংলাদেশের একমাত্র ব্যক্তি যিনি একাধারে ডেপুটি স্পীকার, স্পীকার, উপরাষ্ট্রপতি এবং রাষ্ট্রপতির মতো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৫৩ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন আওয়ামীলীগের দপ্তর সম্পাদক। মুক্তিযুদ্ধের সময় পালন করেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের উপদেষ্টার দায়িত্ব। ১৯৭২ সালে তিনি জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পীকার নির্বাচিত হন। দেশের প্রথম স্পীকার শাহ্ আব্দুল হামিদ মাত্র ১ মাস ২০ দিনের মাথায় মৃত্যুবরণ করলে তিনি গ্রহণ করেন স্পীকারের দায়িত্ব। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী পদত্যাগ করলে ১৯৭৩ সালে তার হাতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ১৯৭৪ সালে তাকে পূর্ণ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচন করা হয়। বাকশাল গঠনের পর বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হলে তিনি পান ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর খন্দকার মোশতাক তাকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দেন। খন্দকার মোশতাকের পতনের সাথে সাথে তার পদেরও সমাপ্তি ঘটে। ১৯৮০ সালে বিএনপিতে যোগ দিয়ে তিনি জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হন। ১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ বিচারপতি আবদুস সাত্তার তাকে দ্বিতীয় বারের মতো উপরাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত করেন। কিন্তু ১ দিন না যেতেই সেনা অভ্যুত্থানে বিএনপি সরকারের পতন হলে তিনিও হারান তার দায়িত্ব। ১৯৯১ সালে তিনি বিএনপির প্রার্থী হিসেবে লক্ষীপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আবার ফিরে আসেন তার পুরনো দল আওয়ামীলীগে। ১৯৯৯ সালের ১১ নভেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

শেষ পর্বে আমরা আলোচনা করবো বাকি ৫ জন উপরাষ্ট্রপতিকে (বিচারপতি আবদুস সাত্তার, মির্জা নূরুল হুদা, বিচারপতি এ কে এম নূরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ) নিয়ে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

Similar Posts