মেফ্লাওয়ার জাহাজ থেকে ন্যাশনাল হলিডে- আমেরিকার থ্যাংকসগিভিং (১)
আমেরিকায় প্রতি বছর নভেম্বর মাসের চতুর্থ বা শেষ বৃহস্পতিবারে পালিত হয় থ্যাংকসগিভিং। এটা তাদের ন্যাশনাল হলিডে এবং এর গুরুত্ব তাদের কাছে অনেক বেশি। বৃহস্পতি, শুক্র, শনি এবং রবিবার সব মিলিয়ে মোট চারদিন ছুটি পাওয়া যায়। পুরো আমেরিকা তখন ঘরে ফেরার জন্য উন্মুখ থাকে। সবার তখন বাসায় ফেরার তাড়া। সব এয়ারলাইনস, বাস, ট্রেনের টিকিট অনেক আগেই বুকড হয়ে যায়। সবাই এই ছুটিটা পরিবারের সাথে কাটাতে চায়। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি, অফিস, আদালত সব বন্ধ থাকে। আমাদের এপার্টমেন্টের পাশের যে বাসাগুলোতে শিক্ষার্থীরা থাকে সেগুলো পুরো খালি হয়ে যায়।
আমেরিকান সংস্কতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন সংস্থা প্রতিবছর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের থ্যাংকসগিভিং ডিনারে আমন্ত্রণ জানায়। এটা সাধারণত থ্যাংকসগিভিং এর আগের সপ্তাহ গুলোতে হয়ে থাকে। গতানুগতিক আমেরিকান ফাস্টফুডের চেয়ে ভিন্নধর্মী খাবার সেখানে পরিবেশন করা হয় যার মাঝে অবশ্যই থাকে টার্কি পাখি এবং ভুট্টা। খাবারের বৈচিত্র্যও থাকে অনেক বেশি এবং সেগুলোর স্বাদ বাসায় তৈরি খাবারের মতো। মিষ্টিকুমড়ার কেক, বাদামের পাই, সেদ্ধ আলু ও আলুর স্যালাড, রোস্টেড টার্কি, ক্র্যানবেরি চাটনিসহ আরো অনেক ঐতিহ্যবাহী আমেরিকান খাবার প্রথমবারের মতো খাওয়া হয়েছে এই থ্যাংকসগিভিং ডিনারগুলোতে। শরতের শেষে এবং শীত শুরুর আগে এসময় কৃষকেরা ঘরে ফসল উঠায়, থ্যাংকসগিভিং ডিনারে সেসব খাবারই প্রাধান্য পায়। প্রতিবারের নিমন্ত্রণে একটা ডকুমেন্টারি দেখানো হত যে থ্যাংকসগিভিং উৎসবটা ঠিক কিভাবে শুরু হল।
থ্যাংকসগিভিং এর ইতিহাস আজ থেকে প্রায় চারশত বছরের পুরনো। আমেরিকায় তখন ইউরোপিয়ান সেটেলারদের যাতায়াত শুরু হয়েছে, তবে তাদের কাছে আমেরিকা তখন নিউ ওয়ার্ল্ড নামে বেশি পরিচিত ছিল কারণ আমেরিকার অনেকাংশ তখনো তাদের অজানা ছিল। সেসময় (১৬০০ সালের দিকে) ইংল্যান্ডের রাজা ছিলেন জেমস প্রথম। ইংল্যান্ডের অধিকাংশ মানুষ খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী ছিল কিন্তু রাজা চাইতেন, তিনি যেভাবে বলবেন, সকলকে সেভাবে ধর্ম পালন করতে হবে। তার আদেশই আইন, সকলে তা মেনে চলতে বাধ্য এবং সেভাবেই তিনি চার্চে যোগদানের নিয়মকানুন সাজালেন। রাজার আরোপিত ধর্মপালনের এই বিধিনিষেধ, একদল ইংরেজ ভালোভাবে মেনে নিতে পারল না। তারা নিজেদের পিউরিটান বলতো। তারা চাইতো রাজার আদেশ নয়, বরং বাইবেলে যেভাবে বর্ণিত আছে সেভাবে ধর্মপালন করতে। শাস্তির ভয়ে রাজাকে লুকিয়ে গোপনে তারা তাদের মতানুসারে প্রার্থনা করতো। কিন্তু এভাবে আর কতোদিন?
শেষ পর্যন্ত নিজেদের সবটুকু সঞ্চয় নিয়ে এক কোম্পানির সাথে পিউরিটানরা চুক্তি করে। তারপরে তারা নিউ ওয়ার্ল্ডের (আমেরিকা) উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। সেই জাহাজটার নাম ছিল মেফ্লাওয়ার। কিন্তু তাদের যাত্রা করতে কিছুটা দেরি হয়ে গেল, গ্রীষ্মকাল তখন প্রায় শেষ। গ্রীষ্মের শেষে আটলান্টিক মহাসাগরে তখন ঝড়ের মৌসুম। আর জাহাজে যাত্রীও ছিল ধারণ ক্ষমতার চেয়ে বেশি। ফলে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ল, খাদ্যাভাব দেখা দিল। দুই মাসেরও বেশি সময়ের দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার পরে তারা তীরের দেখা পেল। তাদের গন্তব্য ছিল নিউইয়র্ক কিন্তু ঝড় তাদের সেখান থেকে অনেক দূরে ম্য়াসাচুসেটসে নিয়ে এসেছিল। তারা এত ক্লান্ত ছিল যে আবারো নিউইয়র্কের পথে যাত্রার মতো শক্তি কারোরই অবশিষ্ট ছিল না। ম্য়াসাচুসেটসের যে জায়গায় তারা নেমেছিল, সেটা পুরোটাই বনভূমি ছিল। কিছু স্থানীয় মানুষ বা নেটিভ আমেরিকান (তারা ওয়াম্পানোয়াগ নামে পরিচিত) সেখানে বাস করত। পিউরিটানরা এমন পরিবেশে থাকার জন্য মোটেও অভ্যস্ত ছিল না। খাদ্যের অভাব তীব্র হয়ে দেখা দিল, ইংল্যান্ড থেকে সাথে করে নিয়ে আসা শস্যের বীজ থেকে ভালোমত ফসল হল না।
বুনো পরিবেশে শিকার করতেও তারা পারদর্শী ছিল না। ফলে প্রথম বছরের শীতে পিউরিটানদের অনেকেই মারা গেল।
(পরবর্তী অংশে সমাপ্য)