কলকাতা ডার্বি: মোহনবাগান – ইস্ট বেঙ্গল দ্বৈরথের স্মরণীয় কিছু ম্যাচ [পর্ব- ১]

১৯২৫ সাল থেকে শুরু হয়েছে কলকাতার ঐতিহ্যবাহী দুই ফুটবল ক্লাব মোহনবাগান ও ইস্ট বেঙ্গলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। মোহনবাগান সমর্থন পেয়েছে কলকাতার আদিম নিবাসী বলে দাবিদার ‘ঘটি’দের। আর ইস্ট বেঙ্গলের সমর্থক গোষ্ঠী তৈরী হয়েছে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশ থেকে বঙ্গভঙ্গ ও দেশ ভাগের সময় কলকাতা বা পশ্চিম বঙ্গে অভিবাসিত হওয়া মানুষদের মধ্য থেকে যাদেরকে বলা হয় ‘বাঙ্গাল’। এসব অনেক পুরনো কথা।

kolkata-derby-mohun-bagan-vs-east-bengal-1st-part

প্রায় শতাব্দী প্রাচীন দ্বৈরথ মোহনবাগান – ইস্ট বেঙ্গল এর মধ্যকার ম্যাচের বহুল প্রচলিত নাম ‘কলকাতা ডার্বি’ বা ‘বড় ম্যাচ’। কলকাতার ফুটবল মানেই বোঝায় সল্ট লেক স্টেডিয়ামে (যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন) এর ডার্বি ম্যাচ। ভারত জুড়ে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু এখনো বাঙ্গালি ফুটবল দর্শকদের মাঝে কলকাতা ডার্বির আবেদন যেন কমেনি এতটুকুও। ম্যাচের দিন তাই দেখা যায় হাজারো দর্শকের উপচে পড়া ভিড়ে ঠাঁই দাঁড়ানো দায় হয়ে যায় স্টেডিয়ামে। লাল-হলুদ আর সবুজ-মেরুন রঙ্গে ছেয়ে যায় চারদিক যা পরিচয় বহন করে যথাক্রমে ইস্ট বেঙ্গল আর মোহনবাগানের। একটি কিংবদন্তি দ্বৈরথ শুধু খেলার মাঠে প্রতিপক্ষের জালে বল ছুঁইয়ে দিয়েই তৈরী হয় না। এর পিছনে থাকে নানা গল্প। থাকে হর্ষ-বিষাদ, আনন্দ-বেদনার অজস্র স্মৃতি। এবারের লেখাটি সাজানো হয়েছে এমনই কিছু স্মরণীয় ডার্বি ম্যাচ নিয়ে।

১৯৭৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর, আইএফএ শিল্ডের ফাইনাল ম্যাচ। ‘৭০ এর দশকটি ছিল ইস্ট বেঙ্গলের। ফর্মে তুঙ্গে থাকা ইস্ট বেঙ্গল সেদিন মোহনবাগানকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত করে দিয়েছিল। পেনাল্টি মিস করার পরেও শ্যাম থাপার জোড়া গোল আর সুরজিত সেনগুপ্ত, রঞ্জিত মুখোপাধ্যায় ও শুভঙ্কর স্যান্নাল এর আক্রমণে ম্যাচ শেষে স্কোর দাঁড়িয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল ৫—০ মোহনবাগান। ইস্ট বেঙ্গল ছ’বছর আগে তৎকালীন ভারতের সবচেয়ে বড় ফুটবল প্রতিযোগিতা আইএফএ শিল্ডের ফাইনালে মোহনবাগানের কাছে ৩—১ গোলে হারের মধুর প্রতিশোধ নিয়েছিল সেদিন।

 

 East Bengal Club
১৯৭৫ সালের আইএফএ শিল্ড ফাইনাল জয়ের পর ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের খেলোয়াড়দের মাঠ প্রদক্ষিণ; Image source : East Bengal Ultras

 

মাঠের পরাজয়েই শেষ হয়ে যায়নি মোহনবাগানের খেলোয়াড়দের সেদিনের বিড়ম্বনা। লজ্জাজনক হারে আবেগাক্রান্ত বাগান সমর্থকরা সেদিন খেলোয়াড়দের আটকে রেখেছিল ক্লাব তাঁবুতেই। চালে যেন নেমে এসেছিল শিলাবৃষ্টি। ক্লাবের পিছনের গেইট দিয়ে পালিয়ে বেঁচেছিলেন মোহনবাগানের দুই খেলোয়াড় সুব্রত ভট্টাচার্য ও প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়। সমর্থকদের রোষের মুখে গা ঢাকা দিয়েছিলেন গঙ্গার বুকে, সারা রাত কাটাতে হয়েছিল নৌকাতে।

শুধু তাই নয়। এই হারের যন্ত্রণা সইতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন বাগানের একজন কট্টর সমর্থক উমাকান্ত পালোধি। সুইসাইড নোটে লিখে গিয়েছিলেন, ‘পরের জন্মে বাগানের ফুটবলার হয়েই এই হারের প্রতিশোধ নেব।’

উমাকান্ত পালোধি হয়তো আর ফিরে আসবেন না ধরণীতে। তার মতো সমর্থকদের জন্মই যেন হয়েছে মিথ তৈরী করতে। প্রিয় ক্লাবকে ঘিরে অনুভূতিরর সর্বোচ্চ বহিঃপ্রকাশই করে গেলেন তিনি নিজের জীবন বলি দান করে।

 

১৯৭৫ সালের আইএফএ শিল্ড ফাইনালে মোহনবাগান ৫—০ গোলে সে হারের প্রতিশোধ ঠিকই নিয়েছিল। সুযোগ পেলেই ইস্ট বেঙ্গল সমর্থকরা হাতের পাঁচ আঙ্গুল দেখিয়ে বিদ্রুপ করত মোহনবাগান সমর্থকদের। মাথা নীচু করে থাকতে হতো বাগান সমর্থকদের। ঐতিহাসিক সে হারের লজ্জায় চোখ তুলে তাকানোর সুযোগ পেত না তারা। ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিল প্রতিশোধের আগুন। অবশেষে সেই ক্ষোভটা ঝাড়ার সুযোগ পেয়েছিল মোহনবাগান ২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর । সেদিন মোহনবাগান জিতেছিল ৫—৩ গোলে। আই লিগের সে ম্যাচটি ছিল যেন নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার চিডি এডে এর একক আলোয় উদ্ভাসিত। প্রথম কোনো বিদেশি হিসেবে ডার্বিতে হ্যাটট্রিকের রেকর্ড গড়েছিলেন তিনি। সেদিনই ডার্বিতে এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ৪ গোলের রেকর্ডটাও নিজের করে নিয়েছিলেন চিডি এডে। এর মাধ্যমে দীর্ঘ ৩৪ বছরের লজ্জাজনক গ্লানির জবাব দিতে পেরেছিল মোহনবাগান। সে ম্যাচের মাধ্যমে নিজ দলের সমর্থকদের ইস্ট বেঙ্গল সমর্থক দ্বারা দীর্ঘদিনের ঠাট্টা উপহার পাওয়া থেকে মুক্তি দিয়েছিল মোহনবাগানের খেলোয়াড়েরা।

 

রেকর্ড ও সংঘাত; দুই মিলিয়েই ইতিহাস। আগামী পর্বে থাকছে এমন আরো ক’টি ডার্বি ম্যাচের গল্প।

Similar Posts