ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী- বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম (৪র্থ পর্ব)

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও দর্শনীয় স্থানের ধারক হিসেবে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি প্রাচীনকাল থেকেই বন্দর নগরী হিসেবে চট্টগ্রামের অর্থনীতি ও বাণিজ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে । বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানের মতো চট্টগ্রামেও কৃষি, বাণিজ্য ও শিল্প ভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে উঠেছে । চট্টগ্রাম শহরের জিডিপি ৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার । এটি দক্ষিণ এশিয়ায় ৫ম বৃহৎ অর্থনীতির শহর । চট্টগ্রামে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল বা ইপিজেড স্থাপন করা হয় । চট্টগ্রামের মধ্য দিয়েই সঞ্চালিত হয় দেশের অর্থনৈতিক জীবনী শক্তি । সরকারি হিসেব অনুযায়ী, দেশের সর্বমোট রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৭৫ ভাগ সংঘটিত হয় চট্টগ্রামের উপর দিয়ে । আমদানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৮০ ভাগ । দেশের মোট রাজস্ব আয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে চট্টগ্রামের ব্যবসা- বাণিজ্য থেকে । বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের শতকরা ৯০ ভাগ সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দিয়ে। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও চট্টগ্রাম এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

chittagong-witness-to-history-and-tradition

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হয় চট্টগ্রামকে । জিডিপিতে চট্টগ্রামের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ । এখানে রয়েছে ৩টি ইপিজেড বা রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল । সরকারি হিসেব অনুযায়ী, এখানে প্রায় ৩২৮টি ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, ৪৩২৩টি ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান, ২৪টি পাটকল, ৫টি সরকারি বস্ত্রকল, ১০টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, ৬৪৭টি গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল ফ্যাক্টরি, ১টি তেল শোধনাগার, ৩টি সার কারখানা, ২৩টি চা বাগান, প্রায় ৮০টি জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প, ১২টি বহুজাতিক কোম্পানি, ৬২৮টি বৈদেশিক কোম্পানি রয়েছে।

নদী, সাগর ও জলাধার বিধৌত এলাকা হওয়ার সুবাদে চট্টগ্রাম জেলায় মাছ চাষের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন । চট্টগ্রাম শহরের অদূরে হালদা নদীর উৎসমুখ থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত মিঠা পানির মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র হিসেবে বেশ উর্বর। মাছের প্রজনন মৌসুমে এই এলাকাকে সরকারি উদ্যোগে বিশেষভাবে পরিচর্যা করা হয় ও নজরদারিতে রাখা হয় । চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর মোহনায় প্রায় ৬ লক্ষ ৪০ হাজার একর এলাকা মাছ ধরার জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে । চিংড়ি, সামুদ্রিক হাঙ্গর, স্কেট, রে, শার্কফিন প্রভৃতি বিদেশেও রপ্তানি করা হয়। চট্টগ্রাম মাছ চাষের জন্য সুপ্রাচীন হওয়ার কারণে এখানে শুঁটকি প্রস্তুত করাও ঐতিহ্যেরই একটি অংশ । সোনাদিয়া, সন্দ্বীপ ইত্যাদি দ্বীপাঞ্চলে মাছ শুকিয়ে শুঁটকি প্রস্তুত করা হয়।

এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস প্রজনন কেন্দ্র- হালদা নদী।
এশিয়ার একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস প্রজনন কেন্দ্র- হালদা নদী।

অর্থনীতিতে অনেক ভূমিকা থাকার কারণে চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী বলা হলেও অবকাঠামোগত নানা সুযোগ- সুবিধার অভাবে এখানকার বাণিজ্যে প্রাচীনকালের তুলনায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। সমুদ্র বন্দরের সুবিধার কারণে এই শহরে ছুটে এসেছিলো বহু হালকা, মাঝারি ও ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং বহুজাতিক কোম্পানি। কিন্তু ব্যবসা- বাণিজ্যের জন্য সহায়ক নানা অবকাঠামো ও নীতিগত অনুমোদনের সুযোগ- সুবিধা ঢাকায় কেন্দ্রীভূত হওয়ার কারণে চট্টগ্রামে এই বাণিজ্যিক পরিবেশে ভাটা পড়তে থাকে। গত কয়েক দশকে চট্টগ্রাম ছেড়ে যায় অনেক বড় বড় উদ্যোক্তা।

শিল্প- কারখানা স্থাপন ও আমদানি- রপ্তানির অনেক সেবার অনুমোদন ঢাকা থেকে নিতে হয় ব্যবসায়ীদের । চট্টগ্রামে কয়েকটি কার্যালয় শক্তিশালী করলেও বা অনলাইনে সেবা চালু করা হলেও তা নিতান্তই সামান্য মাত্র, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ঢাকার উপর নির্ভরশীল হতে হয়। শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক অনেক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই চট্টগ্রামের সরকারি সংস্থাগুলোর । নৌ পরিবহন এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো বিশেষ উইং চট্টগ্রামে নেই।

বঙ্গবন্ধুর সময়ে ঢাকার বাইরে অনেক সংস্থার প্রধান কার্যালয় নেওয়া হলেও তা পরবর্তীতে ফিরিয়ে নেয়া হয়। বর্তমানে চট্টগ্রামে যে কয়েকটি প্রধান কার্যালয় আছে, তা-ও ঢাকার মুখাপেক্ষী।

বাণিজ্যের প্রয়োজনে বিদেশি ক্রেতা- বিক্রেতাদের সরাসরি চট্টগ্রামে আসার জন্য দরকার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর। চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর থাকলেও মাত্র ৯টি গন্তব্যে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল করছে। কলকাতা ছাড়া বাকি সব গন্তব্যই মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক। এক দশকে বন্ধ হয়েছে সিঙ্গাপুর, কুয়েত, ব্যাংকক, মালয়েশিয়া রুট। চট্টগ্রাম ছেড়েছে ৭টি বিদেশি এয়ারলাইন্স কোম্পানি। অর্থাৎ ঢাকা হয়ে তবেই বিদেশের সাথে যোগাযোগ করতে হয় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারী এবং বিদেশি ক্রেতাদের।

চট্টগ্রামে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য বা শিল্পকারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে বারবার ঢাকায় ছুটে যেতে হয়। ব্যাংক ঋণ থেকে শুরু করে আমদানি- রপ্তানির অনুমোদন এবং বড় বড় কারবার সবই ঢাকা থেকে নিয়ন্ত্রণ হয়। দেশে ৫৯টি ব্যাংক থাকলেও বর্তমানে একটিরও প্রধান কার্যালয় চট্টগ্রামে নেই। শিল্পকারখানায় উৎপন্ন পণ্যের মান পরীক্ষা ও তদারকির ক্ষেত্রে বিএসটিআই চট্টগ্রাম কার্যালয়ের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা থাকায় এক্ষেত্রেও ঢাকায় ছুটোছুটি করতে হয়।

ব্যবসা- বাণিজ্যের বহুমুখী সম্ভাবনা থাকলেও নানা কারণেই বাণিজ্যিক রাজধানীর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। এ সমস্যা নিরসনে সর্বাগ্রে দরকার ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ কথাটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে, অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ আবশ্যক। তবেই চট্টগ্রামের সুফল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পুরোপুরিভাবে পাওয়া সম্ভব হবে। এটা অনস্বীকার্য যে, একটা দেশের কাঙ্ক্ষিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের দ্রুত প্রসারের জন্য সমুদ্র বন্দর পূর্বশর্ত। যার মাধ্যমেই দেশের মূলত সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটে। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর আমাদের অর্থনীতিতে প্রাণশক্তির মতো কাজ করায় দেশের সুষম ও টেকসই প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের জন্য এর ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। তাই অর্থনীতির ক্ষেত্রে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সুফল পেতে সরকারি উদ্যোগ ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন।

(সমাপ্ত)

Similar Posts