অন্তুর চিঠি
সে বছর জোছনাকান্দি গ্রাম থেকে একটি ছেলে হায়ার সেকেন্ডারিতে উত্তীর্ণ হয়েছিল। গ্রামের মানুষের মধ্যে সে কী উচ্ছাস,উন্মাদনা,হুলস্থূল কাণ্ড! পাশের গ্রামের পঙ্গু রহিম চাচা থেকে শুরু করে আধ ক্রোশ দূরের গ্রাম শৈলবিছার দিনমজুর মমতাজ চাচি, সবাই দেখতে এসেছিল অন্তুকে। গ্রামের সবার আদরের অন্তু শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবে। চারিদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ। এদিকে ছোটবেলায় পিতৃহারা ছেলেটির পড়ার খরচ নিয়ে চিন্তায় মগ্ন মা সাহেরা বানু।
বারান্দায় বসে কখনও সবার মুখে ছেলের প্রশংসা শুনে হেসে উঠছেন। কখনওবা ছেলেকে কত কষ্ট করে বড় করেছেন, লেখাপড়া করিয়েছেন সেই গল্প বলতেই কান্নায় ভেঙ্গে পরছেন। অন্য মহিলারা সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন,”কি করতিচো,বুবু? আরে, এমুন দিনে কেউ কান্দে? দেইখবা,আমাদের অন্তু শহরে গিয়ে বিরাট ব্যারিশ্টার হবি। একটু হাসো দেকিনি।”অন্তুর মা আঁচলে চোখ মোছে। কান্নাকে হাসিতে পরিণত করার চেষ্টা।হঠাৎ অনেক মানুষের বাড়ির উঠানে ডাকাডাকি। জানালা দিয়ে গাঁয়ের চেয়ারম্যানকে দেখা যায়। সাহেরা বানু ঘর থেকে ধ্বংসাবশেষ কাঠের চেয়ারখানা নিয়ে এক দৌড়ে উঠানে চলে গেলেন। ঘোমটা টেনে দিয়ে তাকে বসতে অনুরোধ করেন। চেয়ারম্যান পঙ্কজ বাবু গ্রামের সবার প্রিয়, আস্থার শেষ আশ্রয়। তাঁর খুশি যেন আর ধরে না! সেই আসা অবধি যে হাসির সাইনবোর্ড মুখে এঁটে দিয়েছেন তা আর নামানোর কোনো লক্ষণ নেই।কাঁদো কাঁদো হয়ে অন্তুর মা বললেন,” দ্যাহেন তো চেয়ারমেন সাব পোলার কাণ্ড! দুইবেলা খাতি পারে না,হে আবার লিহাপড়া করতি শহরে যাতি চায়। আমি এত টেহা কই পাই? ওর বাপটাতো মইরে গিয়ে বাঁইচে গিছে। আমার হইছে যত জ্বালা!”
হাসির সাইনবোর্ড খুলি খুলি অবস্থায় পঙ্কজ বাবু ঘোষণা দিলেন,”অন্তু আমাগে গেরামের গর্ব। হে শহরে যাইব লিহাপড়া করতি, ইডা তো খুশি খবর।টেহা পয়সা নিয়া তুমি ভাইবো না,অন্তুর মা।আমি সব ব্যবস্তা করতিছি।”
গাঁয়ের চেয়ারম্যানের প্রচেষ্টায় এবং গ্রামের সবার সহযোগিতায় অন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিল। ব্যারিস্টার হওয়ার বাসনা নিয়ে ভর্তি হলো আইন বিভাগে।
–
অন্তু তখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। শহরের সাথে ততটা খাপ খাওয়াতে পারেনি গ্রামের ক্ষেতে লাঙ্গল দেওয়া ছেলেটি। দেশে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে আঁচ করতে পারছে। হলগুলো প্রায় ফাঁকা,সবাই বেশ তেতে আছে মনে হচ্ছে। সেদিন চায়ের দোকানে চা পান করতেছিল অন্তু। তরুণ দোকানি চা পরিবেশন করছে। আরও কিছু তরুণ বসে আছে, চাপা স্বরে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে। দোকানি তরুণ কিছুক্ষণ পর পর জ্বলে উঠছেন যেন! “শেখ সাব সাত মার্চে যা কইছে ওইটাই শ্যাষ কতা। আর কোনো কতা নাই।” চায়ের কাপ ধোয়ায় মনযোগী হলেন আর বিড়বিড় করে বলে চলেছেন,” দ্যাশটারে মগেরমুল্লুক পাইছে!”
পাশ থেকে এক তরুণ ফিসফিসিয়ে,”শুনলাম ভুট্টো আর ইয়াহিয়া নাকি অনেক অস্ত্রসস্ত্র আনতেছে আমাদের নিরাপত্তার জন্য।” তার পাশ থেকে অন্য এক তরুণ বজ্রকণ্ঠে- নিরাপত্তা না ছাই! মনে করছে আমরা কিছু বুঝি না! সব ফন্দিফিকির! আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে,যেকোনো সময় ঝাঁপিয়ে পরতে হতে পারে!” অন্যরা মাথা নাড়িয়ে সায় দিল,তারাও একমত।
অন্ত চায়ের দাম মিটিয়ে হলে নিজের ঘরে চলে গেল। শুয়ে ‘শেখ সাহেব’ আর ‘ঝাঁপিয়ে পরা’ নিয়ে অনেক ভেবেও কোনো অর্থ দাড় করাতে পারল না।বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। গ্রামের বন্ধুরা, গ্রামের মানুষগুলো, মায়ে মুখখানা, ক্ষেতে লাঙ্গল দিয়ে হাল চাষ করা,পুকুরে ঝাঁপিয়ে গোসল করা,সাঁতার কাটা। ঝাঁপিয়ে পরা! নাহ,অনেক কষ্টেও এটা মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না। মা’কে সুন্দর করে সব লিখে একটা চিঠি লিখল অন্তু। চিঠির নিচে তারিখ লিখল, ২৫ মার্চ ১৯৭১, বৃহস্পতিবার ! সন্ধ্যায় চিঠিটা তড়িঘড়ি করে পোস্টবক্সে ফেলে দিয়ে রাত ন’টা নাগাদ হলে ফিরল। হলে আরও দশ থেকে বারোজন আছে। তাদের সাথে গল্প করা যায়। কিন্তু অন্তু ভীষণ ক্লান্ত,ঘুম পাচ্ছে। নিজের রুমে গিয়ে গা এলিয়ে দিল বিছানায়। ঘুমিয়ে পড়ল।
মাঝরাতে হঠাৎ বিকট আওয়াজ,গোলাগুলির শব্দ,কান্নার আহাজারি। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই দু’জন খাকি পোশাকধারী ঘরের ভিতরে ঢুকে পড়ল!
সকালে স্থানীয়রা হল থেকে তেরটা লাশ বের করে,আট নম্বরটা অন্তুর!
–
মাইকে কথাগুলো বলতে বলতে শাড়ীর সাদা আঁচল দিয়ে বারকয়েক চোখ মুছলেন সাহেরা বানু। বাংলাদেশ সরকার যে ৮০ জন বীরাঙ্গনাকে ‘নারী মুক্তিযোদ্ধা ‘র স্বীকৃতি দিয়েছে,তিনি তাদের একজন।
হঠাৎ কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে সাহেরা বানুর। রোস্ট্রাম তার ভার রাখতে পারে না,মাটিতে লুটিয়ে পরেন তিনি। একটা হাত বজ্রমুষ্টিবদ্ধ। যেন কোনো মহামূল্যবান ধন আগলে রেখেছেন সযত্নে,কাউকে দিতে চান না তা। চর্মসার দেহটি ক্রমেই নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। মুষ্টিবদ্ধ হাত শিথিল হচ্ছে। খসখসে একটা শব্দ। শরীরটা একেবারেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে রইল। হাতের ফাঁকে একটা কাগজ,একটা চিঠি! অন্তুর চিঠি!