টমাস হবস: একজন বাস্তববাদী দার্শনিকের গল্প

টমাস হবস সেই দার্শনিক যাকে ব্রিটেনের “মৌলিক চিন্তাধারা সম্পন্ন রাজনৈতিক দার্শনিক” বলা হয়। ১৫৮৮ সালের ৫ই এপ্রিল ইংল্যান্ডের উইল্টসায়ারের অন্তর্ভুক্ত মামসবারি নামক স্থানে এক যাজক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথমে মামসবারিতে শিক্ষালাভ করলেও পরবর্তীতে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেন।    

Thomas Hobbes Biography

ইংল্যান্ডের গৃহযুদ্ধের ফলে হবস রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন। তার “ডি সাইভ” গ্রন্থে রাষ্ট্র সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। এটি আধুনিক যুগের সমাজবিজ্ঞান ও সমাজ-মনোবিজ্ঞানের উল্লেখযোগ্য একটি গ্রন্থ। এছাড়াও তার গ্রন্থগুলো হচ্ছে- “দ্যা এলিমেন্টস ওফ ল’স”,” লেভিয়াথান”,”ডি করপোর”,”ডি হোমিন”। সবচেয়ে মূল্যবান ও আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ হলো “লেভিয়াথান”।  এ গ্রন্থটি মূলত নৈতিক ও রাজনৈতিক তত্ত্বের  উপর রচিত। এখানে  তৎকালীন ইউরোপ তথা ইংল্যান্ডের শক্তিশালী শাসনব্যবস্থার কথা জোর দিয়ে উল্লেখ করেন।

টমাস হবস ছিলেন একজন বাস্তববাদী দার্শনিক। বস্তুবাদে বিশ্বাস করতেন। তার মতে,”ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য অভিজ্ঞতাই হলো সকল জ্ঞানের আকর”। মানব প্রকৃতির বিশ্লেষণ হবসের চিন্তাধার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। তিনি মানব দেহকে তিনি বস্তু ও মানব মনকে ক্ষয়িষ্ণু পদার্থ হিসাবে বিবেচনা করেছেন। তিনি মনে করেন, মানুষ অন্যান্য জড় বস্তুর ন্যায়। মানুষ ও জড় বস্তুর মধ্যে সামান্য পার্থক্য হচ্ছে যুক্তি নামক একটি বিশেষ অতিরিক্ত উপাদান।  যুক্তির সাহায্যে সে ভাবনা-চিন্তা করে তাঁর চাওয়া পাওয়া অত্যন্ত ফলপ্রসূভাবে সম্পাদন করতে চায়।

আকাঙ্ক্ষা ও বিতৃষ্ণার প্রভাব নিয়ে হবসের মতামত ছিলো এরকম- মানুষের যাবতীয় কর্মপ্রয়াস,আবেগ আকর্ষণ ও বিকর্ষণ  ” আকাঙ্ক্ষা” ও “বিতৃষ্ণা” র দুটি মূল অভিপ্রায় থেকে উৎসারিত। যে জিনিস মানুষের অনুভূতিতে অনুকূল সাড়া জাগায় সে জিনিসের প্রতি  মানুষের আকর্ষণ জন্মে এবং তা লাভ করার জন্য সে আকাঙ্ক্ষা করে। অপরপক্ষে,  প্রতিকূল সাড়া জাগালে বিতৃষ্ণা জন্মে এবং দুঃখবোধ করে। আনন্দদায়ক বস্তু মানুষের জন্য কল্যাণকর অন্যথায় অকল্যাণের। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির তারতম্য অনুসারে কল্যাণ অকল্যাণের হেরফের হতে পারে।

মানব প্রকৃতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো -মানুষ আকাঙ্ক্ষা দ্বারা পরিচালিত হলেও সে তার আকাঙ্ক্ষাকে কেবলমাত্র বর্তমানের সুখান্বেষণে সীমাবদ্ধ রাখে না। আকাঙ্ক্ষা মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে এমন এক ক্ষমতা যার সাহায্যে সে তার ভবিষ্যৎআকাঙ্ক্ষার পথকে সুগম করতে পারে। হবসের নিজের ভাষায় বলা হয়,”কোনো এক সময়ে মাত্র একবার উপভোগ করা মানুষের আকাঙ্ক্ষার লক্ষ্য নয় বরং তার আকাঙ্ক্ষার লক্ষ্য হচ্ছে ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষার পথ নিশ্চিত করা।” 

মানুষ মানুষে বড় রকমের কোনো পার্থক্য নেই,তারা মোটামুটি সকলেই সমান। এর অর্থ এই না যে মানসিক ও দৈহিক দিক দিয়ে সকল মানুষ এক ও অভিন্ন ক্ষমতার অধিকারী। হবসের মতে, মানুষ এ অর্থে পরস্পর সমান যে, কারো হয়ত দৈহিক বল কম আছে কিন্তু তার মনের বল বেশি। আবার যে মনের দিক থেকে দুর্বল, সে দৈহিক ভাবে সবল। সুতরাং, দৈহিক ও মানসিক ক্ষমতার কথা সার্বিকভাবে বিচার করলে যথার্থই মানুষের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো অসমতা থাকেনা,”মানুষ স্বভাবতই স্বার্থপর,লোভী,আত্মকেন্দ্রিক এবং ক্ষমতালিপ্সু।” সকল মানুষের ক্ষেত্রেই সত্য। 

টমাস হবসের কথা সুখবাদী দার্শনিকদের মত মনে হলেও তাকে সুখবাদীর পর্যায়ভুক্ত করা যায় না। মানব প্রকৃতি,সামাজিক চুক্তি, সার্বভৌম নিয়ে আগ্রহী এই দার্শনিক ১৬৭৯ সালের ৪ ডিসেম্বর  মৃত্যুবরণ করেন। 

Similar Posts