ছোটগল্প- অস্থির সময় (শেষ অংশ)

আমেরিকায় পড়াশোনা করতে আসার সময় পিউকে সাথে আনতে পারেনি তপু। কিছু আর্থিক সমস্যা ছিল। তাছাড়া সরকারি স্কুলের চাকরিটাও হুট করে ছেড়ে চলে আসতে চায়নি পিউ। ঠিক ছিল তপু আসার পরে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব পিউয়ের ভিসার জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠাবে।

একটু গুছিয়ে নিয়ে প্রায় মাস দুয়েকের মাঝে তপু সব কাগজপত্র পাঠিয়ে দিয়েছিল। পিউ ভিসা ইন্টারভিউয়ের তারিখ নেয়। আর তার ঠিক পরেই করোনা মহামারী হঠাৎ সবকিছু ওলট পালট করে দেয়। ঢাকার আমেরিকান এম্ব্যাসি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এম্ব্যাসি থেকে ইমেইলে জানিয়ে দেয় যে সকল ভিসা ইন্টারভিউ বাতিল করা হয়েছে।

A turbulent time

পিউ সেদিন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। ফোন দিয়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করে। এই প্রথম তপু ফোনের ভেতরে এভাবে পিউকে কাঁদতে দেখল। সেদিন যে তপুর কতোটা খারাপ লেগেছিল সেটা সে ঠিক বোঝাতে পারবে না। সারারাত ঘুম আসেনি, চোখ দু’টো খুব জ্বালাপোড়া করছিল।

পিউকে ছেড়ে এখানে সত্যিই কিছু ভালো লাগে না তার। তপু অনেকবার বলার চেষ্টা করেছে – জানো পিউ, তোমাকে ছাড়া আমার কিছু ভালো লাগে না। কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি। প্রতিবারই মুখে এসে আটকে যায়, আর বলা হয় না। একথা শুনে পিউ যদি আবার কেঁদে দেয়….

পিউয়ের আসার কথা ছিল এবছরের গ্রীষ্মে। আর এখন চলছে নভেম্বর মাস। তপুর এখানে পড়তে আসা প্রায় একবছর হয়ে যাচ্ছে। ২০১৯ র ডিসেম্বরে এসেছিল সে। আর তারপর করোনার জন্য স্প্রিং আর সামার সেমিস্টারের পুরোটা অনলাইনে ক্লাস করেই কেটেছে। ফল সেমিস্টারের কিছু ক্লাস ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে করতে হয়। কয়েকদিন পর ইউনিভার্সিটির সব ক্লাস, পরীক্ষা আবার অনলাইনে চলে যাবে, তারপরে ক্রিসমাসের ছুটি।

(৩)

তপুর মিটিং, ল্যাবের কাজ সব শেষ করে বেরোতে বেরোতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। বিল্ডিং এর ভেতরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। বাইরে বের হয়ে দেখে হালকা তুষারপাত শুরু হয়েছে। হেঁটে কিছুদূর গিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে সে। বাসটা একদম তার এপার্টমেন্টের কাছাকাছি নামিয়ে দেয়।

আমেরিকার শীতকাল যে ভয়ংকর সেটা তপু আগে অনেকের কাছে শুনেছে। কিন্তু সেটা যে এতোটা ভয়াবহ সে সম্পর্কে তার কোন ধারণা ছিল না। চারটা বাজতেই সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে আসে, আর সেই রাত এতো দীর্ঘ যে শেষই হতে চায় না। গাছগুলোর একটাতেও পাতা থাকেনা, শীতের শুরুতেই সব ঝরে যায়। শূন্য গাছগুলো কেমন ভুতুড়ে দেখায়। দিনের পর দিন মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি, তুষারপাত দেখতে দেখতে তপু ক্লান্ত। আর সাথে হাড় হিম করা বাতাস, বাইরে বের হওয়ার উপায় নেই। রৌদ্র ঝলমলে দিন খুব কম আসে।

আমেরিকায় আসার পর থেকেই অল্প কিছু সময় ছাড়া বেশিরভাগ সময় তপু বাসাতেই বন্দী থেকেছে এই করোনার জন্য। কিছু ক্লাস আর ল্যাবের কাজের জন্য এই সেমিস্টারে ভার্সিটিতে যেতে হয়, তখন তপুর ভালোই লাগে। সবার সাথে দেখা হয়, কথা হয়। বাসায় থাকলে খুব দমবন্ধ লাগে। পিউ থাকলে নিশ্চয়ই এমনটা লাগত না। পিউকে খুব মনে পড়ে, এই কয়টা দিন ওর সাথে ঠিকমতো কথাও হয়নি। কবে আবার দেখা হবে পিউয়ের সাথে?

বাসায় ফিরে এককাপ চা বানায় তপু। চা খেয়ে আবার হোমওয়ার্ক করতে বসতে হবে। জানালার পাশের চেয়ারটায় বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে দেখে কাচে বাষ্প জমে ঘোলাটে হয়ে আছে। বাইরে রাত নেমেছে। তপু বলে ওঠে- “হেই গুগল, প্লিজ প্লে রবীন্দ্রসংগীত”।

গুগলের স্পিকার কিছু গতানুগতিক কথা বলে তারপর বাজানো শুরু করে,

“ফুরায় বেলা, ফুরায় খেলা, সন্ধ্যা হয়ে আসে

কাঁদে তখন আকুল-মন, কাঁপে তরাসে

কি হবে গতি, বিশ্বপতি, শান্তি কোথা আছে

তোমারে দাও, আশা পুরাও, তুমি এসো কাছে

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা………”

শুনতে শুনতে তপুর সামনের জানালার ঝাপসা কাচটা আরো ঝাপসা হয়ে আসে, তার চোখেও বাষ্প জমছে।

(সমাপ্ত)

(চরিত্রগুলো কাল্পনিক, কিন্তু গল্পটা খুব সত্যি এবং এই গল্প অনেকের।)

Similar Posts