ভূমিকম্পের আগাগোড়া
ভূমিকম্প কি? ভূপৃষ্ঠে সৃষ্ট কম্পন হলো ভূমিকম্প। ভূ-অভ্যন্তরে সৃষ্ট আলোড়নের ফলে ভূপৃষ্ঠের কোন কোন অংশে যে আকস্মিক কম্পন হয় তাকে ভূমিকম্প বলে।ভূমিকম্প কয়েক সেকেন্ড থেকে মিনিট খানেক স্থায়ী হয়। ভূপৃষ্ট ছাড়াও সাগরের অভ্যন্তরে ভূমিকম্প হতে পারে। যে স্থানে ভূমিকম্প হয় তাকে কেন্দ্র বলে এবং যতদূর পর্যন্ত এর কম্পন অনুভূত হয় তাকে Direction বলে।পৃথিবীর অভ্যন্তরে যে স্থানে ভূমিকম্প প্রথম অনুভূত হয় তাকে Focus বা Epicentre বলা হয়।
ভূমিকম্পের প্রকারভেদঃ চার ধরনের ভূমিকম্প রয়েছে।
(১) Tectonic earthquake বা গঠনাত্মক ভূমিকম্পঃ ভূতাত্ত্বিক মতবাদ অনুসারে ভূত্বক প্রধানত সাতটি বড় ও কয়েকটি ক্ষুদ্র গতিশীল কঠিনপ্লেট দ্বারা গঠিত। সেগুলো নিম্নস্থ ভ্রাম্যমান উষ্ণ গুরুমন্ডলীয় পদার্থের উপর ভাসছে।প্লেটের বিচরন ও পারস্পারিক ক্রিয়া ভূমিকম্প,অগ্ন্যুৎপাত,পর্বত সৃষ্টি উল্লেখযোগ্য ঘটনার নিয়ন্ত্রক।
(২) Volcanic earthquake বা আগ্নেয়গিরির ভূমিকম্পঃ এই সময় উর্ধ্বমুখী উত্তপ্ত লাভা ও শিলারাশির চাপে নিকটবর্তী স্থানে ভূমিকম্প হয়।
(৩) Collapse earthquake বা ধসের ভূমিকম্পঃ একে মৃদু ধরনের ভূমিকম্পও বলা হয়। কখনো মাটির গভীরে খনিতে বিস্ফোরণ ঘটায়। খনি অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠের কোন অংশ হঠাৎ ধসে পড়লে এধরনের ভূমিকম্প হয়।
(৪) Explosion earthquake বা বিস্ফোরক ভূমিকম্পঃ অনেক সময় ভূ-অভ্যন্তরে মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন কেমিক্যাল ডিভাইসের বিস্ফোরণ ঘটায়। ফলে এক ধরনের কম্পন সৃষ্টি হয়। একে মানবসৃষ্ট ভূমিকম্পও বলা হয়।
ভূমিকম্পের উৎসঃ
শিলাচ্যুতিঃ ভূ-আলোড়নের ফলে পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগে প্রবল ঘর্ষনের ফলে সৃষ্টি হয় এবং ভূত্বকের স্থান বিশেষে শিলাচ্যুতি ঘটে এর ফলে প্রবলভাবে ভূমিকম্প হয়।
ভূত্বকে পরিবর্তনঃ এর ফলে ভূত্বকের উপরিভাগ ভঙ্গিল পর্বত,উপত্যকা ও চ্যুতি সৃষ্টির সময় প্রবল ভূমিকম্প হয়।
ধসঃ পাহাড়ের ঢালু অংশে বৃষ্টিপাতের ফলে ধস নামে। এর কারনে ভূমিকম্প হয়।
পানি বাষ্পীভবনঃ ভূপৃষ্ঠের পানি পৃথিবীর উত্তপ্ত অংশে পৌছালে বাষ্পে পরিণত হয়।এই বাষ্পের পরিমান বেশি হলে তা ভূপৃষ্ঠের নিচে ধাক্কা দেয় ফলে ভূমি কেঁপে ওঠে।
তাপ বিকিরণঃ এর ফলে ভূগর্ভ ক্রমশ সঙ্কুচিত হবার সময় এবং ভূত্বকে ভাজ পড়ার সময় ভূপৃষ্ঠ কেঁপে ওঠে।
অগ্ন্যুদ্গমঃ আগ্নে থেকে অগ্ন্যুউপূতের সময় বহির্মুখী বাষ্প, লাভা প্রভৃতির চাপে আগ্নেয়গিরির নিকটবর্তী স্থানে কেঁপে ওঠে।
হিমানি সম্প্রপাতঃ;ধীরগতিসম্পন্ন প্রকান্ড হিমবাহের কোন অংশে বিচ্ছিন্ন হলে তার গতিবেগ খুব বেড়ে যায়, একে হিমানী সম্প্রপাত বলে। হিমানী সম্প্রপাতের ফলে ভূমিকম্প হয়।
ভূগর্ভের চাপের হ্রাসঃ কোনো কারণে ভূগর্ভে চাপের হ্রাস হলে অভ্যন্তরে অতি উষ্ণ কঠিন পদার্থ গলে নিচের দিকে নামে ও আন্দোলিত হতে থাকে। ফলে ভূপৃষ্ঠ কেঁপে ওঠে।
ভূমিকম্পের ফলাফলঃ ভূমিকম্পের প্রধান শিকার মানুষ,পশুপাখি, গাছপালা। কয়েকমূহুর্তের মধ্যে অনেক লোকের প্রানহানি হয়। এ সময় অত্যাধিক পরিমানে ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়। গ্যাস লাইন, পাম্প স্টেশন এগুলো ভেঙ্গে আগুন লাগার সম্ভাবনা বেশি থাকে। একটি বড় ভূমিকম্পে প্রচুর ধ্বংসস্তূপ তৈরি হয়,একদিকে ইট কাঠের স্তুপ অন্যদিকে মৃত মানুষ ও পশুপাখির স্তুপ। উপকূলীয় অঞ্চলে কখনো কখনো ভূমিকম্পের ফলে বন্যা- জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। সাগরের তলদেশে ভূমিকম্পের ফলে নদ-নদী, হ্রদ এবং সাগরে প্রবল তরঙ্গ সৃষ্টি হয়। এ সময় সাগরের পানি ৬০ থেকে ৭০ ফুট উচু হয়ে প্লাবনের সৃষ্টি করে। ভূমি দেবে যায়, ভূ-চৌম্বকত্ব,ভূগর্ভস্থ পানির তেজস্ক্রিয়ার মাত্রা বৃদ্ধি পায়,ভূমিতে ফাটলের সৃষ্টি হওয়ায় পুনরায় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। ভূৃমিকম্প কিংবা পাহাড় ধসের ফলে নদীতে কখনো কখনো পলি জমে। এর ফলে গতিপথ পরিবর্তন হতে পারে। ১৮৯৭ সালের ১২ জুনের ভূমিকম্পে ব্রক্ষ্মপুত্র নদের গতিপথ বদলে সৃষ্টি হয় যমুনা নদীর।
বাংলাদেশে ভূমিকম্পের কারণঃ মূলত বাংলাদেশে ভূমিকম্প সৃষ্টি হওয়ার কারণ দুটি।
১) ভৌগোলিক অবস্থান ও ভূতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটঃ বাংলাদেশ ভৌগলিক অবস্থানে ভূতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটে ভূমিকম্পের অত্যন্ত ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। হিমালয়, আরাকান, ইয়োমা পর্বতমালা ভূমিকম্পন অঞ্চল -বাংলাদেশ হিমালয় পাদদেশে এবং আরাকান ইয়োমা পর্বতমালার পশ্চিমে। সক্রিয় ভূমিকম্পন প্লেট ইন্ডিয়া ও বার্মা প্লেটের মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান এবং উত্তর -পূর্বে রয়েছে ডাউকি ডেস্কার ফল্ট যাকে কেন্দ্র করে অতীত কয়েকটি ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্প ঘটে। ফলে যে কোনো সময় ভূমিকম্প হবার যৌক্তিক সম্ভাবনা আছে।
২)অপরিকল্পিত নগরায়নঃ বাংলাদেশে ছিন্নমূল মানুষ এসে নগরীতে বসবাস করছে। জরিপ অনুসারে প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৮০ হাজার লোক বাস করছে ঢাকায়। জনসংখ্যার সাথে সাথে উঁচু দালান, নিম্ন মানের বিদ্যুৎ লাইন ও গ্যাস লাইন বাড়ছে। বিল্ডিং কোড না মেনে, সয়েল টেস্ট না করে, অদক্ষ নকশায় বাড়ি, কারখানা,শিল্প এলাকা গড়ে উঠছে।এ বিষয়গুলো ভূমিকম্প হবার সম্ভবনাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড.এ এইচ এম মাকসুদ কামালের মতে, চট্রগ্রামে ভূমিকম্পের ঝুকির জন্য নগরায়ন দায়ী। নরম মাটির উপর নগরায়ন হচ্ছে। সেখানে ভূমিকম্পের সম্ভবনা বেশি।(২০০৯ : সংবাদ)
আবহাওয়াবিদ এম এম এমরান চৌধুরী বলেন, ঢাকা মহানগর ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভূমিকম্পের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। মাটির নিচ থেকে মাত্রাতিরিক্ত পানি উত্তোলন,স্তরে ফাটল, আলোড়নে মাটির স্তর ক্রমেই বেড়ে চলছে যা শহরাঞ্চলের ভূমিকম্পের কারণ।
ভূমিকম্পে করণীয়ঃ
জনগনের প্রাথমিক প্রতিরোধঃ
- হুইসেল, মাস্ক, আগুন নেভানোর যন্ত্র বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন বন্ধের নিয়ম পরিবারের সকলের জানতে হবে।
- জরুরি টেলিফোন নাম্বার মুখস্থ করে বা কাছে রাখবে।
- ভালো আর্কিটেকচারের নির্দেশনায় বিল্ডিং কোড ব্যবহার করে বিল্ডিং বানাবে।
- ঘর থেকে বের হওয়ার বিকল্প ব্যবস্থা থাকবে।
- ঘরের বড় আসবাবপত্রগুলো শক্তভাবে পিছন থেকে আটকে রাখার ব্যবস্থা থাকবে। ইত্যাদি।
ভূমিকম্প চলার সময়ঃ
- মজবুত টেবিল,উচু খাটের নিচ আশ্রয় নেয়ার জন্য ব্যবহার করা।
- ঘরের পিলারের গা ঘেঁষে আশ্রয় নেয়া।
- ঘরের বাইরে থাকলে উচু দালান,গ্যাস,বিদ্যুৎ থেকে দূরে থাকা এবং ঘরে প্রবেশ না করা।
- লিফট,চলন্ত সিড়ি,উন্মুক্ত সিড়ি ব্যবহার না করা।
- গাড়িতে থাকলে ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয়া।
ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ঃ
- খালি পায়ে না হাঁটা যাবে না।
- গ্যাস লাইন,বিদ্যুৎ লাইন,টেলিফোনের সমস্যা দেখে নেয়া।
- পয়ঃনিষ্কাশন লাইন সচল হলে ব্যবহার করা নয়তো মহামারী ছড়াতে পারে।
- প্রয়োজনের বেশি মোবাইল ব্যবহার না করা।
- রেডিও-টিভির জরুরি বার্তা শোনা।
- ত্রান বিতরণে সাহায্য করা।
- বড় ধরনের ভূমিকম্পের পর আবারও ভূমিকম্প হবার সম্ভাবনা থাকে সে কারণে বড় ভূমিকম্পের পর তিনদিন নিরাপদ স্থানে থাকা।
- গুজবে বিশ্বাস না করে নিজেদের শান্ত রাখা।