ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী-বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম (৩য় পর্ব)

ইতিহাস, সংস্কৃতি ও লোকজ উৎসবের পাশাপাশি চট্টগ্রামে রয়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমাহার । পাহাড়, নদী, সমুদ্র প্রভৃতির সংমিশ্রণে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্যের আধার। তাই তো একে ‘প্রাচ্যের রাণী’ নামে অভিহিত করা হয় । চট্টগ্রামে রয়েছে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত । এখানে প্রতি বছর অসংখ্য পর্যটক ভিড় জমায় । ফলে পর্যটন শিল্পেও চট্টগ্রাম স্থান করে নিয়েছে ।

Chittagong-witness-to-history-and-tradition

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা নেভাল একাডেমি রোডে রয়েছে বাংলাদেশের একমাত্র প্রজাপতি পার্ক । এই পার্কটিই ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম প্রজাপতি পার্ক । প্রায় ছয় একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত এই পার্কটিতে প্রায় ৬০০ প্রজাতির কয়েক হাজার প্রজাপতি রয়েছে। এই পার্কে রয়েছে ট্রপিক্যাল গার্ডেন, বাটারফ্লাই জোন, বাটারফ্লাই মিউজিয়াম, বাটারফ্লাই রিয়ারিং রুম, কৃত্রিম লেক ও ঝর্ণা, ফিশ ফিডিং জোন ও বাটারফ্লাই ফিডিং জোন ।

দেশের বহু প্রাচীন ও ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে চট্টগ্রামে । মোঘল ও ব্রিটিশ আমলে নির্মিত অনেক ভবন এবং সে সময়কার অপূর্ব স্থাপত্যশৈলীর দেখা মেলে চট্টগ্রামে । চট্টগ্রামের আধিপত্য নিয়ে মোঘল ও পর্তুগিজদের যুদ্ধে মোঘলরা বিজয়ী হওয়ার পর মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে ১৬৬৭ খ্রিষ্টাব্দে শায়েস্তা খাঁ চট্টগ্রামে নির্মাণ করেন আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ ।
নির্মাণের পর থেকেই এই মসজিদ চট্টগ্রামের মুসলমানদের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠে । এই মসজিদের ইমাম বা খতিব হিসেবে মদিনার আওলাদে রাসুলগণকে নিয়োগ দেয়া হতো । আজও সেই ধারা বজায় রাখা হয়েছে । সমতল ভূমি থেকে প্রায় ত্রিশ ফুট উপরে ছোট্ট পাহাড়ের উপর এই মসজিদের অবস্থান। মূল মসজিদের পশ্চিম পাশের দেয়াল পোড়া মাটির তৈরি এবং বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের তৈরি। মূল মসজিদের প্রতিটি দেয়াল প্রায় আড়াই গজ পুরু। মধ্যস্থলে একটি বড় গম্বুজ এবং দুটি ছোট গম্বুজ দ্বারা ছাদ আবৃত । মসজিদটি নির্মাণ কৌশলগত দিক থেকে দিল্লির ঐতিহাসিক জামে মসাজিদের প্রায় প্রতিচ্ছবি হওয়ায় এটি চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুসলিম স্থাপত্য বিকাশের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করে । এই মসজিদটি দিল্লি জামে মসজিদের আদলে বড় বড় পাথর ব্যবহার করে নির্মিত । তাই একে ‘জামে সঙ্গীন’-ও বলা হয় । শৈল্পিক দিক থেকেও এই মসজিদ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারক স্বরূপ শিলালিপি স্থাপন করা হয়েছিলো এই মসজিদের গায়ে ।

আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের কেন্দ্রীয় গম্বুজ।
আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের কেন্দ্রীয় গম্বুজ।

১৭২৩ সালে চট্টগ্রামের আরেক শাসনকর্তা নবাব ইয়াসিন খাঁ আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের কাছাকাছি একটি স্থানে, পাহাড়ের দক্ষিণ- পূর্ব দিকের একটি টিলার উপর আরেকটি পাকা মসজিদ নির্মাণ করেন এবং তাতে ‘কদম রসুল’ স্থাপন করেন । তখন থেকে সেই স্থানের নাম হয়ে যায় ‘কদম মোবারক’। বর্তমানে চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড় মোড়ের পাশে এই কদম মোবারক মসজিদ অবস্থিত। এই মসজিদটিও মোঘল স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন । এই মসজিদের পাশেই রয়েছে নবাব ইয়াসিন খাঁর কবর।

চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার অধীনে টাইগার পাস সংলগ্ন পাহাড়ি এলাকায় রয়েছে সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং বা সিআরবি । ১৮৭২ সালে এই ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয় । এটি বন্দর নগরী চট্টগ্রামের প্রাচীনতম ভবন । এটি বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপকের নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় । সিআরবি পাহাড়ে রয়েছে হাতির বাংলো ও পুলিশ কমিশনারের বাস ভবন । এছাড়াও সিআরবি পাহাড়ের মাঝ বরাবর রয়েছে শিরীষতলা নামের একটি প্রশস্ত মাঠ । এই মাঠে প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন ইত্যাদি উৎসব আয়োজন করা হয় । সিআরবি পাহাড়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে এটিও একটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।

সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং, চট্টগ্রাম।
সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং, চট্টগ্রাম।

চট্টগ্রামের আরেকটি দর্শনীয় স্থান হলো বাটালি হিল বা বাটালি পাহাড় । এটি চট্টগ্রাম শহরের টাইগার পাস এলাকায় অবস্থিত । এটি চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই পাহাড়ের চূড়ায় বিমান বিধ্বংসী কামান স্থাপন করা হয়েছিলো । এই পাহাড়ের চূড়া থেকে বঙ্গোপসাগর এবং চট্টগ্রাম শহরের বড় অংশ স্পষ্টভাবে দেখা যায় । চট্টগ্রাম শহরকে উপর থেকে দেখার জন্য এটি একটি উত্তম স্থান । চলচ্চিত্র নির্মাতারা প্রায়ই এই পাহাড়ের উপর উঠে চট্টগ্রামের দৃশ্য ধারণ করেন । বর্তমানে এই পাহাড়ের পাদদেশে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ভবন বা নগর ভবন রয়েছে ।

চট্টগ্রামের আরো একটি দৃষ্টি নন্দন স্থান হলো ডিসি হিল বা ডিসির পাহাড় । আনুষ্ঠানিক নাম হলো নজরুল চত্বর । এই পাহাড়ের চূড়ায় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক বা ডিসির বাংলো অবস্থিত হওয়ায় এই স্থানটি ‘ডিসি হিল’ নামে পরিচিতি পেয়েছে । ইংরেজ শাসন আমলের শুরুর দিকে এই স্থানে চাকমা রাজার বাড়ি ছিলো । এই পাহাড়ে অনেক সুউচ্চ গাছ রয়েছে । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই পাহাড়ে রয়েছে মুক্তমঞ্চ ও বসবার খোলা জায়গা । এখানে প্রায়ই বিভিন্ন অনুষ্ঠান, জাতীয় দিবস সমূহ পালন, মঞ্চ নাটক ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি প্রতি বছর বর্ষ বরণ, বই মেলা প্রভৃতি উৎসব ঘটা করে পালন করা হয় । আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর জীবদ্দশায় এখানে প্রায়ই আসতেন অবসর সময় কাটাতে । তাই জাতীয় কবির আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে এই স্থানের নাম রাখা হয় ‘নজরুল চত্বর’।

ডিসি হিল বা নজরুল চত্বর।
ডিসি হিল বা নজরুল চত্বর।

আরেকটি দর্শনীয় স্থান হলো চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় অবস্থিত বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকো পার্ক । ১৯৯৮ সালে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ের পাদদেশে এই বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকো পার্ক প্রতিষ্ঠা করা হয় । এটি বাংলাদেশের প্রথম ইকো পার্ক এবং এশিয়া মহা দেশের বৃহত্তম ইকো পার্ক । পার্কটি ১৯৯৬ একর জায়গা নিয়ে গঠিত । প্রায় ১ হাজার একর জায়গা নিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং প্রায় ৯৯৬ একর জায়গা নিয়ে ইকো পার্ক এলাকা গঠিত । এখানে রয়েছে বিরল প্রজাতির গাছপালা, হাজারো রকমের নজরকাড়া আকর্ষণীয় ফুলের গাছ, কৃত্রিম লেক ও নানা প্রজাতির জৈব বৈচিত্র্য । এখানে রয়েছে খুবই দুর্লভ কালো গোলাপ সহ প্রায় ৩৫ প্রকার গোলাপ এবং অন্যান্য ফূল । এখানে পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে দেখা যায় বিভিন্ন প্রজাতির পাখি আর বন্য প্রাণীদের । এখানে রয়েছে ভালুক, বন মোরগ, মায়া হরিণ, বানর, বনরুই প্রভৃতি প্রাণী । বন বিভাগের উদ্যোগে জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে এ স্থানটিকে বিশেষভাবে গড়ে তোলা হয়েছে।

চট্টগ্রামে রয়েছে চুনতি অভয়ারণ্য । এটি জাতিসংঘের স্বীকৃতি প্রাপ্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপরূপ লীলাভূমি । এটি একটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল ও বন্য প্রাণীর প্রাকৃতিক অভয়ারণ্য । চট্টগ্রাম শহরের দক্ষিণে চট্টগ্রাম- কক্সবাজার মহা সড়কের পাশে এটি অবস্থিত । প্রায় ৭৭৬৪ হেক্টর আয়তনের এই অভয়ারণ্য ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় । এই বনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো বিশালাকার শতবর্ষী মাদার গর্জন গাছ । বাংলাদেশ ও মায়ানমারের মধ্যে বন্য এশীয় হাতির যাতায়াতের জন্য একটি করিডোর হিসেবে এই বন জীব বৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে । এই বনে প্রায় ১২ শত প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে । এদের মধ্যে প্রায় ৪৫ প্রজাতির উঁচু গাছ রয়েছে।

এছাড়াও চট্টগ্রামে ফয়েজ লেক, স্বাধীনতা পার্ক, কাজির দেউড়ি জাদুঘর, নেভাল একাডেমি, জাম্বুরি পার্ক, পারকি সমুদ্র সৈকত প্রভৃতি দর্শনীয় স্থান বিখ্যাত।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

Similar Posts