লেকের ধারে বাড়ি-আমেরিকার আরকানসাস অঙ্গরাজ্য ভ্রমণ (শেষ অংশ)

আরকানসাসে আমাদের ঘোরাঘুরির প্ল্যানটা অনেকটা হঠাৎ করেই হয়েছিল। ফলে থাকার জন্য শেষ মুহূর্তে পছন্দসই হোটেল পাওয়া গেল না। আমরা এয়ারবিএনবি খুঁজতে শুরু করলাম। লেক ক্যাথরিনের পাশে একটা বাসা পাওয়া গেল। রিভিউ পড়ার সময় ঠিক ছিল না, আমরা তাড়াহুড়োতে বাসাটা বুক করে ফেললাম।

লেক ক্যাথরিন

হট স্প্রিং ঘোরা শেষে পড়ন্ত বিকেলে বাসাটার সামনে পৌঁছালাম। এয়ারবিএনবি সাইটে বাসাটার খুব বেশি ছবি ছিল না। তবে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে সেটাকে একটা ছোটখাট প্রাসাদ মনে হল। আর বাসার ঠিক পাশেই ছড়িয়ে আছে বিশাল বড় ক্যাথরিন লেক। আমাদের দেখে লেকপাড়ের জেটি থেকে ষাটোর্ধ একজন মানুষ এগিয়ে এলেন। তার চলাফেরার সাবলীলতায় তার বয়েস যে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি সেটা তাকে দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। নিজের ভারি নৌকাখানি তিনি নিজেই টেনে জেটিতে ভিড়াচ্ছিলেন। কাছে এসে আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন; তিনিই আমাদের এয়ারবিএনবি হোস্ট এবং সামনের এই ছবির মতো সুন্দর বাড়িটার মালিক। তারপরে আমাদের নিয়ে চললেন ভেতরে আর তার বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন। ফুলের বাগান, মার্বেল পাথরের ঝর্ণা, এখানে ওখানে ঝুলানো পাখির বাসা, চারধারে ছড়ানো বিশাল বারান্দা-কি নেই সেখানে! শুধু মানুষের বড় অভাব। তার নিজস্ব বেডরুম ছাড়া বাসার বাকি আটটা বেডরুম শূন্য পড়ে থাকে।

ভদ্রলোক কথা বলতে বেশ পছন্দ করেন, আমাদের সাথে অনেক গল্প করে চললেন। এর আগে বেশ কয়েকবার এয়ারবিএনবিতে থাকলেও কখনো হোস্টদের সাথে গল্প করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। তার কথা শুনতে ভালোই লাগছিল। তার এক ছেলে ও মেয়ে চাকরিসূত্রে অন্য শহরে থাকে; ছুটির সময় তারা বাসায় আসে। ভদ্রলোকের স্ত্রী দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভুগে কয়েকমাস আগে গত হয়েছেন। তারপর থেকে তিনি একা। অর্থের অভাব তার নেই। একাকীত্ব দূর করতে তিনি তার বাসাটাকে এয়ারবিএনবিতে তালিকাভুক্ত করেছেন। এই সুন্দর বাসাটায় যখন কেউ এসে থাকে আর লেক ক্যাথরিনের সৌন্দর্য মুগ্ধ নয়নে উপভোগ করে, তখন মানুষের সেই মুগ্ধতা তাকে আনন্দ দেয়। আমাদের বললেন, “তোমরা জ্যোৎস্নারাতে এলে ভালো করতে, সেসময় এই লেকটা আরো সুন্দর দেখায়”।

 

লেকের ধারে বাড়ি
লেকের ধারে বাড়ি

 

আমাদের থাকার ঘর ছিল দোতলায় বাসার একপাশে আর দরজা খুললেই ছড়ানো বারান্দা, সেখানে থেকে অনেকখানি লেক দেখা যায়। আমরা গিয়েছিলাম কৃষ্ণপক্ষের সময়, রাত নামলেই তখন গাঢ় অন্ধকার। বন্ধুরা সহ আমরা মোট পাঁচজন ছিলাম। বেশ রাত পর্যন্ত জেগে গল্প করছিলাম সবাই। বাসার পাশের নেইবারহুডটা এমনিতেই নিরিবিলি, সন্ধ্যা নামার পরে সেটা আরো চুপচাপ হয়ে যায়। একটানা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, মাঝে মাঝে লেকের মাছেদের ডুবশব্দ আর আমাদের কথা ছাড়া আর কোথাও কোন শব্দ নেই। এমন মিশকালো রাতে আকাশে মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারাগুলোকেও অনেক উজ্জ্বল দেখায়। এরকম সময়ে দূর অতীতে ফেলে আসা দিনগুলোকে অনেক বেশি মনে পড়ে, তাদের কোন একটার জন্য মনে কেমন একটা হাহাকার জেগে ওঠে। রাত বাড়তে থাকায় আমরা বারান্দা ছেড়ে ঘরে ফিরে আসি।

পরদিন সকালে পুরো বাসাটা আর লেক ক্যাথরিন আরো ভালোভাবে দেখার সুযোগ হল। শান্ত, স্নিগ্ধ এক লেকের পাশে ছবির মত সুন্দর এক বাড়ি। অনেকক্ষণ লেকের পাশে বসেছিলাম, পাশে দিয়ে হেঁটে এলাম; আশেপাশের সবগুলো বাসাই খুব ছিমছাম। হোস্ট আমাদের আগেই বেশ সকালে উঠে পড়েছিলেন। নিজের হাতে বানানো সিনামন রোল আমাদের খাওয়ালেন। আর জানালেন, উষ্ণ ঝর্ণার জল নিজের বাসা পর্যন্ত নিয়ে আসার ব্যবস্থা তিনি করেছেন এবং প্রতি সকালে সেই জল দিয়েই তিনি কফি তৈরি করেন কারণ সেটা স্বাস্থ্যকর। আমাদেরও বললেন সেই জল দিয়ে তৈরি চা খেয়ে এর স্বাদ পরখ করে দেখতে। সেটা অবশ্য পরে আর করা হয়নি।

আরকানসাসে বেড়িয়ে আসার একবছর হয়ে গেল। এরপরেও যদি কখনো যাই, আমরা এয়ারবিএনবিতে প্রথমেই সেই বাসাটার খোঁজ করব। উষ্ণ ঝর্ণা আর পাহাড়ের সৌন্দর্যের সাথে সেই প্রাসাদোপম বাড়ির মালিকের আন্তরিক আতিথেয়তাও মন ছুঁয়েছিল। কোন একটা মনোরম জায়গায় ভ্রমণে গেলে যখন প্রকৃতির পাশাপাশি সেখানের মানুষগুলোও সুন্দর ব্যবহার আর আতিথেয়তা উপহার দেয়, তখন সেই ভ্রমণটা অনেক পরিপূর্ণ হয় আর সেটার স্মৃতি দীর্ঘদিন মনে দাগ কেটে থাকে।

 

সকালের প্রথম আলোয় লেক ক্যাথরিন
সকালের প্রথম আলোয় লেক ক্যাথরিন

Similar Posts