স্মার্টফোন আসক্তিতে যেভাবে ধ্বংস হচ্ছে সৃজনশীলতা
প্রযুক্তির বিকাশের ফলে আমাদের জীবনযাত্রার ধরণ পরিবর্তিত হচ্ছে জ্যামিতিক হারে। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলস্বরূপই মোবাইল ফোন এসেছে আশীর্বাদ হয়ে, যা আমাদের জীবনকে অনেকাংশে সহজ ও আরামদায়ক করেছে। মানুষের মাঝে পেয়েছে জনপ্রিয়তা, হয়েছে সহজলভ্য। আজকের দিনে মোবাইল ফোন নেই অথবা ফোন সম্পর্কে জানে না এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় প্রতিটা ক্ষেত্রে ব্যবহার হচ্ছে মোবাইল বা স্মার্টফোন। এই অত্যাধিক ব্যবহারের ফলে আমরা আস্তে আস্তে স্মার্টফোনের দিকে ঝুঁকে পরছি। স্মার্টফোনের ভিতরেই নিজের জগৎ সৃষ্টি করে নিচ্ছি আর আমাদের মাঝে জন্ম নিচ্ছে স্মার্টফোন আসক্তি।
স্মার্টফোন আসক্তি আসলে কী? আমাদের বাহ্যিক জীবন ভুলে স্মার্টফোনের জগতে নিমজ্জিত হয়ে থাকা, আমাদের জীবন নানা কাঙ্খিত মুহূর্ত স্মার্টফোন দ্বারা দখল হওয়া, স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারই হলো স্মার্টফোন আসক্তি। স্মার্টফোন আসক্তির ফলে আমরা আমাদের জীবনের অনেক মুহূর্তে হারিয়ে ফেলছি।শুধু তাই নয়, শারীরিক ও মানসিক নানা প্রতিবন্ধকতার কারণ স্মার্টফোন আসক্তি। এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, স্মার্টফোন ব্যবহারকারী একজন মানুষ দিনে গড়ে ১৫০ বার নিজের ফোনটি আনলক করেন। যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। স্মার্টফোনের নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমরা আলাদা আলাদা জগৎ তৈরি করে নিয়েছি। সেই জগতে সময় দিতে গিয়ে আমরা আমাদের পার্থিব জীবন থেকে ছিটকে পরছি। একটু করে নোটিফিকেশন চেক করতে গিয়ে, স্ক্রোল করতে করতে কয়েক ঘন্টা পার করে ফেলছি। এটা আমাদের নিজস্ব যে চিন্তা ভাবনার সময় আছে তা ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের চিন্তা ভাবনা এর প্রশস্ততা সংকীর্ণ করে ফেলছে। আমাদের চিন্তার জগৎ আজ ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার এর জগৎ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। এভাবেই আমাদের সৃজনশীলতার বিকাশ শুধু বাধাগ্রস্ত নয়, সংকীর্ণ হয়ে পরছে।
গবেষকরা স্মার্টফোন আসক্তি-কে ডিজিটাল কোকেন বলে আখ্যায়িত করেছেন। আর এর সবচেয়ে বড় ভিক্টিম হলো শিশু। শিশুদের মাঝেই স্মার্টফোন আসক্তি সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। বাবা- মার অবহেলা এবং প্রশ্রয়ের ফলেই এই আসক্তির সৃষ্টি। শিশুকে খাবার খাওয়ানো অথবা শান্ত রাখার কৌশল হিসেবে বাবা মা তাদের হাতে তুলে দিচ্ছে স্মার্টফোন। যার ফলে শিশুর সৃজনশীল বিকাশ চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, ১-৫ বছরের শিশুর ৯০% ই মোবাইল ফোনে আসক্ত। এতে যে শুধু তাদের সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তা নয়, শারিরীক ভাবে তারা মায়োপিয়া, মাথাব্যথা, চোখব্যথা, ড্রাই আই সহ নানা জটিলতায় ভুগছে। তারা কথা বলা দেরিতে শিখছে, বুদ্ধির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। হারিয়ে ফেলছে সৃজনশীল কর্মকান্ড করার স্পৃহা। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই উচ্চ বিদ্যালয় বা কলেজের শিক্ষার্থীরাও। শতকরা ৩০% শিক্ষার্থী স্কুলে ফেসবুক ব্যবহার করে থাকে। একজন মানুষ দিনে গড়ে ১৫ বার হাসে, সেখানে সে গড়ে ১৫০ বার মোবাইল আনলক করে। যা প্রায় ১০ গুন বেশি। এভাবে তারা নিজেদের স্বাভাবিক বিকাশ ও চিন্তাধারাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
স্মার্টফোন যে শুধু মানসিকভাবে সৃজনশীলতাকে বাধাগ্রস্ত করছে তা নয়। স্মার্টফোন আমাদের সৃজনশীল কর্মকান্ড প্রকাশের প্লাটফর্মে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের প্রভাব-ই এনেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও নানা ব্লগিং ওয়েবসাইট এর মাধ্যমে আজ যে কেউ নিজের লিখা অথবা সৃজনশীল কাজ প্রকাশ করতে পারছে। অনেক ক্ষেত্রে যাচাই বাছাই ছাড়াই এসব প্রকাশ পাচ্ছে। ফলে পাঠক সমাজকে অনেক কুরুচিপূর্ণ ও অযোগ্য কার্যকলাপ এর সম্মুখীন হতে হচ্ছে যার ফলে তাদের সৃজনশীল চিন্তা ভাবনায় নেতিবাচক প্রভাব পরছে। তারা সৃজনশীল কাজ ও লেখালেখির প্রতি আগ্রহ হারাচ্ছে। সংকীর্ণ মানসিকতা সংকীর্ণ চিন্তা ভাবনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে।
সৃজনশীলতাকে সময় দিতে হয়। হুট করেই কিছু করা সম্ভব নয়। তার পেছনে চিন্তা করতে হয়, দিতে হয় শ্রম। নিজেকে পরিপূর্ণ রুপে তুলে ধরার জন্য আগে নিজেকে জানতে হয়। আর নিজেকে জানার জন্য নিজস্ব সময়ের প্রয়োজন হয়। এত ব্যস্ততার মাঝে যেটুকু সময় বেঁচে থাকে তাও এই মোবাইলের পেছনে আমরা ব্যায় করি।
এতক্ষণ স্মার্টফোনের আসক্তির জন্য সৃজনশীলতা ব্যাহত হওয়ার কথা বললাম। তবে এই স্মার্টফোনের সঠিক ব্যবহার করতে পারলে এটি আপনার সৃজনশীলতা বিকাশে সাহায্য করবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফলে অসংখ্য প্ল্যাটফর্ম তৈরির নেতিবাচক দিকটা একটু আগেই বলেছি। এবার এর ইতিবাচক দিক বলি। অসংখ্য প্ল্যাটফর্ম এর ফলে অযোগ্য, কুরুচিপূর্ন লেখা বা কাজ ছড়িয়ে পরছে তা ঠিক তবে এই প্ল্যাটফর্মই অনেকের সৃজনশীলতা প্রকাশের মাধ্যম। আগে প্ল্যাটফর্মের অভাবে অনেকের সুপ্ত প্রতিভা প্রকাশ পেত না। কিন্তু এখন আমরা সেই সময় পার করে এসেছি মোবাইল ফোনের বদৌলতেই।
স্মার্টফোনে আসক্ত না হয়ে এর সঠিক ব্যবহার করে আমাদের সৃজনশীল মানসিকতার বিকাশ সম্ভব বলে আমি মনে করি। তবে আমরা আগে-ই যারা আসক্ত হয়ে পরছি তারা কী করব? স্মার্টফোন আসক্তি হতে বাঁচতে তাহলে কিছু পদক্ষেপ নিতে পারেন। স্মার্টফোন ছাড়া আজকের দিনে টিকে থাকা অসম্ভব হলেও এর ব্যবহার এর মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব। এর জন্য যা যা আমরা করতে পারি-
১. ১-৫ বছরের শিশুর হাতে কোন ভাবেই স্মার্টফোন তুলে দেওয়া যাবে না। এ ব্যাপারে বাবা-মাকে সতর্ক হতে হবে। এটাই শিশুর বিকাশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়।
২. আমরা টিনেজার ও অ্যাডাল্ট যারা আছি তারা পড়ালেখা অথবা কাজের সময় স্মার্টফোন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে হবে। স্মার্টফোনের ইন্টারনেট সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করে ফোনটি দূরে সরিয়ে রাখলে তা আমাদের জন্য সহজ হবে।
৩.আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজের যে জগৎ তৈরি করে নিয়েছি তা থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে হবে। যার জন্য আমাদের সত্যিকারের জীবন সম্পর্কে আরো মনযোগী হতে হবে। পরিবারকে সময় ও নানা মানুষের সাথে ইন্টারেকশনের মাধ্যমে এটা আমরা করতে পারি।
৪. আমরা নিজেদের অবসর সময় স্মার্টফোনের ব্যায় না করে নিজেকে নানা সৃজনশীল কাজে নিয়োজিত করব। বাহিরে হাঁটব, নানা মানুষের সাথে পরিচিত হব,বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা করব, লেখালেখি, চিত্রাঙ্কন নানাভাবে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে পারি।
৫. সৃজনশীলতার বিকাশের জন্য নিজেকে সময় দেয়া প্রয়োজন। আমরা প্রতিদিন নিজেকে ১ ঘন্টা করে সময় দিব। এ সময় কোনোভাবেই স্মার্টফোন অথবা টেলিভিশনের কাছে যাওয়া যাবে না। মোবাইল ফোনটির ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে নিলে এতে আমাদের সুবিধা হবে।
৬. নিজেকে একটা রুটিনের মধ্যে নিয়ে আসব এবং সেই রুটিন সম্পুর্ন করতে পারলে নিজেকে নিজে নানাভাবে পুরস্কৃত করব। যাতে করে আমরা রুটিন ঠিকমতো মেনে চলতে আগ্রহী হই।
আমাদের কারো পক্ষেই মোবাইল বাদ দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। আমি বাদ দিয়ে দিতেও বলছি না। আসক্তি থেকে বাঁচতে মোবাইল বন্ধ করে রাখতেও বলছি না। কেনানা মোবাইলকে আমাদের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যমই বলা যায় এখন। মোবাইল বন্ধ রাখলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা, সংবাদ, বিপদের পূর্বাভাস আমাদের নিকট সঠিকভাবে পৌছাবে না। তবে আমরা নিজেদের একটা রুটিনের মধ্যে এনে এর আসক্তি অবশ্যই কমাতে পারি।
চলুন আমরা সবাই নিজেকে স্মার্টফোনের আসক্তি থেকে বের করে নিজেকে মুক্ত বাতাসে তুলে ধরি, খুঁজে বের করি নিজের সুপ্ত প্রতিভা। এই পৃথিবীকে আলোকিত করার ব্রতে ব্রতী হই। নতুনভাবে বাঁচতে শিখি।