কফি মেশিনের সেই গল্পটা

সালটা ১৯৯১। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার ল্যাবে গবেষণায় নিমগ্ন থাকতেন কিছু নিরলস গবেষক। ওখানকার সবার কাছে কম্পিউটার ল্যাবটি “ট্রোজান রুম” নামে পরিচিত ছিল। রাত-দিন চলতো গবেষণা।

 

কফি মেশিনের সেই গল্পটা

ট্রোজান রুমের উল্টোদিকের রুমে ছিলো একটি কফি মেশিন। ট্রোজান রুম ও এর আশেপাশের ল্যাবের গবেষকদের জন্যও এটিই ছিলো রাতের বেলায় ক্যাফেইনের একমাত্র ভরসা। কফি মেশিনটি একাই ট্রোজান রুমের বাসিন্দা ও তার আশেপাশের অধিবাসীদের রাত জেগে কাজ করার জ্বালানির জোগান দিতো। তাই রাত-বিরাতে আধপাগলা হয়ে কফির জন্য তাদেরকে এখানেই ছুটে আসতে হতো। এভাবেই মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছিলো কফি মেশিনটি।

কিন্তু একটা সমস্যা ছিলো। মাঝে মাঝেই  গবেষকরা কাজ ফেলে কফি আনতে গিয়ে দেখতো কফির মেশিনটি ফাঁকা। এটা ছিলো চরম বিরক্তিকর একটা বিষয়। গবেষণার কাজে গভীর মনোনিবেশ থকাকালে পাশ দিয়ে মাছি উড়ে গেলেও গবেষকরা বিরক্ত হন। সেখানে কাজ ফেলে কফির আশায় এতটা পথ অতিক্রম করে যেয়ে যদি কফিই না পাওয়া যায়, বিষয়টা আসলেও ভয়ঙ্কর কষটদায়ক।

 

তাই এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন কম্পিউটার ল্যাবের একদল গবেষক। তারা এ সমস্যার একটা সহজ সমাধান খুঁজতে লাগলেন, এবং পেয়েও গেলেন একটা অভিনব উপায়! তারা তাদের এই ছোট্ট দলটির নাম দিলেন ‘কফি ক্লাব’। দলটির দলনেতা ছিলেন দু’জন- পল ও ফ্র্যাজার।

 

কফি রুমটায় কিছু কম্পিউটার অনেকদিন ধরে অকেজো হয়ে পড়েছিলো। সেখান থেকে একটা কম্পিউটারকে ঐ বিল্ডিংয়ের নেটওয়ার্কের সাথে জুড়ে দেওয়া হলো। আর কফি মেশিনের দিকে ঘুরিয়ে বসিয়ে দেওয়া হলো ছোট্ট একটি ক্যামেরা।  ক্যামেরাটি ছিলো ফিলিপস্’এর। পল লিখলেন একটা সার্ভার প্রোগ্রাম।  আর ফ্র্যাজার লিখলেন একটি ক্লায়েন্ট প্রোগ্রাম।  তিনি এ ক্লায়েন্ট প্রোগ্রামটির নাম দিলেন “XCoffee”।

কম্পিউটার প্রকৌশলী জনসন বলেন, ‘এখানে করা প্রোগ্রামটির প্রথম সংস্করণটি ছিলো মোটামুটি বারো লাইনের বা তারও কম”।

সার্ভার প্রোগ্রামের মাধ্যমে ক্যামেরাটি মিনিটে তিনটি ছবি তুলতে পারতো।  প্রতিটা ছবির আকার ছিলো ১২৮ × ১২৮ পিক্সেল। সেই ছবি পরে আপলোড করা হতো নেটওয়ার্কে।আর সেজন্য ২৪ ঘন্টাই রুমটিকে  আলোকিত রাখা হতো।

আর ক্লায়েন্ট প্রোগ্রাম (XCoffee)-এর মাধ্যমে ঐ ল্যাব ও তার আশেপাশে থাকা সকল পিসির ইউজার পিসিতে বসেই  প্রতি মিনিটে তিনটি ছবি দেখতে পেতেন, আর বুঝতে পারতেন কফি মেশিনের সর্বশেষ অবস্থা। বিবিসির সাথে এক ইন্টারভিউতে ফ্র্যাজার বলেন, ‘ ছবিগুলোর মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য থাকতো না। ছবিতে হয় একটি ভরা কফির পাত্র অথবা একটি খালি কফির পাত্র দেখা যেতো। কিন্তু মজার বিষয় হতো যখন ছবিতে অর্ধভর্তি কফির পাত্র দেখা যেতো, তখন এটা বোঝা মুশকিল ছিলো যে পাত্রটি আসলে ভরছে নাকি খালি হচ্ছে!’

 

এই চমৎকার উদ্ভাবনাটি গবেষকদের কষ্ট লাঘব করার পাশাপাশি অনেক সময়ও বাঁচিয়ে দিচ্ছিলো। এতে করে তাদের আর কফির আশায় আধপাগলা অবস্থায় ছুটে এসে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হতো না। তখনই বোঝা যাচ্ছিলো যে এভাবে কফি মনিটরিংয়ের যে ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিলো সেটা দিয়ে আরও বড় কিছু করা যাবে।

 

এভাবে প্রায় দশ বছর কেটে গেলো। কিন্তু আস্তে আস্ত কিছু সমস্যা ধরা দিতে থাকলো। এমনিতেও ছবিগুলো ছিলো ঝিরঝিরে আর ফাটা ফাটা। আর ধীরে ধীরে প্রোগ্রামটি অচল হয়ে পড়ছিলো। তাই গবেষকরা জিনিসটি বাতিল করে নতুন কিছু নিয়ে কাজ করতে চাইলো। তাই দীর্ঘ দশ বছর পর ২০০১ সালের ২২শে আগস্ট ৯টা ৫৪ মিনিটে ক্যামেরাটি আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেসময় XCoffee  তে  তোলা শেষ ছবিটি এখনও ইন্টারনেটে পাওয়া যায় ( পোস্টে সংযুক্ত করা হয়েছে)। ঘটনাটি উঠে আসে জনপ্রিয় কিছু পত্রিকায়, যেমন: “The Times”, “The Washington Post”। “The Guardian ” এও এ নিয়ে আর্টিকেল ছাপা হয়।

 

এরপর ট্রোজান রুমের কফি পটটিকে ইবে (eBay)-তে নিলামে তোলা হয়। “Spiegel Online” নামক একটি জার্মান ওয়েবসাইটের কাছে বিক্রি করা হয় £৩৩৫০ মূল্যে।

এভাবেই শেষ হয় ট্রোজান রুমের কফি পটের কাহিনী।

 

বর্তমানে কম্পিউটার ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বর্তমানে অনেক উন্নত হয়ে গেছে, যা ঊনিশ বছর আগে হয়তো কল্পনারও বাইরে ছিলো। তখন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের কোনো সার্চ ইঞ্জিন ছিলো না, কোনো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ছিলো না, ছিলো না কোনো ওয়েবক্যাম। কিন্তু সামান্য এক কফি মেশিন আর কফির জন্য আকুল কিছু পাগলাটে প্রোগ্রামার এই বিশাল নেটওয়ার্কের একটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ফেলেছিলো। এভাবেই ১৯৯৩ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব স্থির ছবি প্রদর্শনের সামর্থ্য অর্জন করে। এই ছোট্ট উদ্ভাবনার উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আধুনিককালের ওয়েবক্যাম প্রযুক্তি, যার দ্বারা ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে প্রিয়জন মুহূর্তেই পাচ্ছে প্রিয়জনেরর খবর, হচ্ছে কতো ব্যবসায়িক আলাপ, আরও কতো কি!  এর উপর ভিত্তি করে বিলিয়ন ডলারের বিজনেসও চলছে সহজেই।

 

অথচ XCoffee-র প্রোগ্রামার ফ্র্যাজার এ সম্পর্কে বলেন, “এটা তো ছিলো এক অলস বিকেলের আড্ডায় উঠে আসা একটা পাগলাটে চিন্তা”।

কফি মেশিনের শেষ ছবিটি

Similar Posts

One Comment

Comments are closed.