বেগম আজিমুন্নেসার জীবন্ত সমাধির কারণ কী?
মুর্শিদাবাদের বেগম আজিমুন্নেসার জীবন্ত সমাধির কথা লোকমুখে বেশ প্রচলিত। আজিমুন্নেসা ছিলেন নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর একমাত্র কন্যা এবং উড়িষ্যার নবাব ( বাংলার দ্বিতীয় নবাব) সুজা উদ্দিন মোহাম্মদ খানের স্ত্রী। তিনি কলিজা খেকো (বা কলিজা খালি) নামেই বেশ বিখ্যাত ছিলেন।
তাকে কেন কলিজা খেকো বলা হয়?
প্রচলিত আছে, তিনি সেকালের খুবই ভয়াবহ একজন নারী ছিলেন। তিনি একবার ভয়ংকর দূরারোগ্য একটি রোগে আক্রান্ত হয়ে যান এবং সেই রোগের কোন চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছিল না। মরণব্যাধিটি তাকে গ্রাস করে ফেলবে ঠিক সে সময় একজন হাকিম তাকে একটি অদ্ভুত চিকিৎসার কথা বলে। চিকিৎসাটি ছিল এরকম- তাকে দীর্ঘ এক মাস (মতানৈক্য দেড় মাস) মনুষ্য বাচ্চাদের কলিজা খেতে হবে। কলিজা খেলে এই রোগটি সেরে যাবে। তবে এর একটি পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে এবং সেটি হল এই কলিজা দীর্ঘ এক মাস খেলে নেশার মতন ধরে যাবে। স্বাভাবিক ভাবেই নেশাটা খুব-ই বাজে পরিণতি-ই দেবে।
যাই হোক, অদ্ভুত এই চিকিৎসার কথা শুনে বেগম একটু অবাক হন ঠিকই। কিন্তু সবাই-ই তো বাঁচতে চায়। তাই তিনিও বাঁচতে চেয়েছিলেন। বাঁচার আকাঙ্খা নিয়ে তিনি এই অদ্ভুত চিকিৎসা পদ্ধতি মেনে নিয়েছিলেন। সেকালের তার এত ক্ষমতা ছিল যে কোনো কর্মচারীর পক্ষে তাকে মানা করা সম্ভব ছিল না। তার কর্মচারীরা তাকে তিন বছরের কম বাচ্চাদের কলিজা এনে দিতেন, আর তিনি সেটা ঔষধ হিসেবে গ্রহণ করতেন। শোনা যায়, তাকে এই ঔষধটা লুকিয়ে এনে দেওয়া হতো। তিনি প্রতিনিয়ত মনুষ্য কলিজা খেতেন এবং খুব অদ্ভূত ভাবেই এই মরণব্যাধি রোগটি সেরে যায়।
কিন্তু হাকিমের কথামতো এই কাজটি একবার শুরু করলে নেশা লেগে যাওয়ার কথা। তাই বেগমেরও নেশা লেগে গিয়েছিল এবং তিনি সে নেশা থেকে কিছুতেই ছুটে আসতে পারছিলেন না। একবার সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি প্রতিনিয়ত কলিজা সেবন করতে থাকেন। ফলে গ্রামে বাচ্চা চুরির ঘটনাটা বেশ ভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে প্রায় অনেকগুলো বাচ্চা চুরি ঘটনা ঘটায় কলিজা খাওয়ার ফলে গ্রামে বাচ্চা চুরির ঘটনাটি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কাজটি খুব গোপনে করা হলেও আজিমুন্নেসার এই নিষ্ঠুর কাজের ব্যাপারটা এক সময় তার পিতা নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ জেনে যান। তিনি তার একমাত্র মেয়ের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং তার মেয়েকে জীবন্ত কবর দেন।
তবে আরও একটি কারণ বেশ প্রচলিত। সেটা হচ্ছে- এই মনুষ্য কলিজা খাওয়ার ব্যাপারটা তার স্বামী নবাব সুজা উদ্দিন মোহাম্মদ খান জেনে যান এবং তাকে শাস্তি স্বরূপ সিড়ির নিচে জীবন্ত কবর দেন। যাতে তার কবরের উপর দিয়ে মানুষ হাঁটা চলা করে এবং তার পাপের প্রায়শ্চিত্ত হয়। বলা হয়ে থাকে বেগম আজিমুন্নেসা একাধিক পুরুষে আসক্ত ছিলেন ফলে তার স্বামীর সাথে তার সম্পর্ক ভালো ছিলো না। এজন্য তার স্বামী তাকে এই মনুষ্য কলিজা খাওয়ার অপরাধে জ্যান্ত কবর দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেননি।
কিন্তু অনেকের মতে এসব লোক গুজব। তার কারণ, ইতিহাসের পাতায় এসবের কিছু উল্লেখ নেই। বেগম আজিমুন্নেসার ছেলে সরফরাজ খানের (যিনি কি না নবাব পুত্র) জীবদ্দশায় তার মায়ের মৃত্যু ঘটে। তার সামনে তার মাকে জীবিত কবর দেওয়া হবে আর তিনি সেটার প্রতিবাদ করবেন না, এরকমটা ঠিক মানা যায় না। আর তাছাড়া বেগম আজিমুন্নেসা খুব ধর্ম পরায়ণ মহিলা ছিলেন। তিনি বেঁচে থাকতে অনেক ভালো কাজ করে গেছেন। একটি মসজিদও তৈরী করেন (পরবর্তীতে যেই মসজিদের নিচে তাকে দাফন করা হয়)।
একজন ধর্ম পরায়ণ মানুষ এরকম একটা ন্যাক্কারজনক কাজ করবে, এটা বিশ্বাস করতেও অনেকের অসুবিধা হয়ে থাকে। তবে তিনি যেমনই ছিলেন না কেন, বাস্তবতা যেমনি হোক না কেন, বর্তমান লোক-বিশ্বাস অনুসারে তিনি একজন পাপী ও কলঙ্কিনী নারী।