বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন যারা (শেষ পর্ব)

১ম পর্বের পরে…

বিচারপতি আবদুস সাত্তার (১৯০৬-১৯৮৫)

the-vice-presidents-of-bangladesh

বিচারপতি আবদুস সাত্তার
পাকিস্তান আমল থেকেই বিচারপতি আবদুস সাত্তার অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে এসেছেন। ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী আই আই চন্দ্রিগড়ের মন্ত্রিসভার স্বরাষ্ট্র ও শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। তিনি ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি এবং ১৯৬৮-৬৯ সালে পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতি ছিলেন। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালে তাকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমের বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং সেইসাথে আইন ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও তার হাতে হস্তান্তর করা হয়।

১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান তাকে বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হলে তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শুরু করেন। তার কিছুদিন পর তিনি জনগণের সরাসরি ভোটে দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু মাত্র কয়েক মাসের মাথায় ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল এরশাদ তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন। ১৯৮৫ সালের ৫ অক্টোবর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

মির্জা নূরুল হুদা (১৯১৯-১৯৯১)

বিচারপতি এ কে এম নূরুল ইসলাম
মির্জা নূরুল হুদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার পাশাপাশি পাকিস্তান সরকারের বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী। ১৯৬৯ সালের ২৩ মার্চ গণঅভ্যুত্থানের সময় আবদুল মোনেম খানকে সরিয়ে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। ২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করলে একদিন দায়িত্ব পালনের মাথায়ই তিনি পদত্যাগ করেন। ফিরে যান আবার শিক্ষকতা পেশায়। ১৯৭৫ সালের ২৬ নভেম্বর তিনি বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের ২৪ নভেম্বর জিয়াউর রহমান তাকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করেন। ১৯৮১ সালের ২৪ নভেম্বর বিচারপতি আবদুস সাত্তার তাকে উপরাষ্ট্রপতি পদে নিযুক্ত করেন। ১৯৮২ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত তিনি এই পদে বহাল ছিলেন। তিনি ১৯৯১ সালের ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

বিচারপতি এ কে এম নূরুল ইসলাম (১৯১৯-২০১৫)

বিচারপতি এ কে এম নূরুল ইসলাম
রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালনকারী বিচারপতি এ কে এম নূরুল ইসলাম ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত হাইকোর্টের বিচারপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৮৫ সালে তাকে দেওয়া হয় আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব। ১৯৮৬ সালের ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাকে উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ দান করেন। তিনি ২০১৫ সালের ১৪ নভেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ (১৯৪০- )

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ
মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বিএনপি ও জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। তিনি ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয় উপ-প্রধানমন্ত্রী পদে। সেনা অভ্যুত্থানের পর জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে ১৯৮৫ সালে পান তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। ১৯৮৬ সালে তাকে আবার উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৮৮ সালে তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদ তাকে উপরাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন ঘটলে তার পদেরও সমাপ্তি ঘটে। ১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার পর আবার যোগ দেন বিএনপিতে। অষ্টম জাতীয় সংসদে তিনি আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ (১৯৩০- )

বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ
বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে প্রশাসন ক্যাডারে কর্মজীবন শুরু করলেও ১৯৬০ সালের জুন মাসে তাকে বিচার বিভাগে বদলি করা হয়। ১৯৬৭ সালে তাকে ঢাকা হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭২ সালের ২০ জানুয়ারি তাকে বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারক হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ১৯৮০ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তাকে সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। একই বছরের ৬ ডিসেম্বর এরশাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানের ফলে তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদ পদত্যাগ করেন এবং সকল দলের ঐক্যমতে তিনি উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। একই দিনে রাষ্ট্রপতি এরশাদ পদত্যাগ করলে তার কাছে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্বও অর্পিত হয়। সরকারপ্রধান হিসেবে তিনি নিরপেক্ষ অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেন। তার নেতৃত্বেই ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন হয়। উপরাষ্ট্রপতি ও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ১৯৯১ সালের ১০ অক্টোবর তিনি আবার প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ফিরে যান। ১৯৯৫ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তিনি প্রধান বিচারপতির পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকার আবার তার হাতে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব অর্পণ করে। অবশেষে ২০০১ সালের ১৪ নভেম্বর তিনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

Similar Posts