অগ্নিঝরা মার্চ আমাদের অহংকার

বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকা একটি মাসের নাম মার্চ। বাংলাদেশের আন্দোলন- সংগ্রামের ঘটনাবহুল ও বেদনাবিধুর স্মৃতি বিজড়িত এই মার্চেই শুরু হয়েছিলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘ ২৩ বছরের শাসন, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আন্দোলন হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৬ শে মার্চ শুরু হয়েছিলো সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধ। তাই মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে একটি অবিস্মরণীয় ও শিক্ষণীয় মাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

মার্চ

অনাবিল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সম্পদ ও সম্ভাবনার আধার আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। তাই বিভিন্ন ভিনদেশি শাসকগোষ্ঠী চোখ দিয়েছিলো এই জনপদের উপর। শাসন করতে চেয়েছিলো আমাদের, চেয়েছিলো এদেশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে। পর্তুগিজ জলদস্যুদের থেকে শুরু করে ইউরোপীয় বিভিন্ন বণিকগোষ্ঠী সময়ে সময়ে এদেশের বিভিন্ন অঞ্চল দখল করেছে। স্বজন ও রাজ কর্মচারীদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবারের নির্মম পরাজয় ঘটলে এদেশের শাসন ক্ষমতা চলে যায় ইংরেজদের হাতে। ইংরেজরা এদেশের সম্পদ পাচার করে, এদেশের মানুষকে শোষণ করে, ধ্বংস করে দেয় এদেশের অর্থনীতি ও সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ। ‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতিতে সৃষ্টি করে নানা অনৈক্য ও বিভেদ। তবে এদেশের মানুষের প্রতিরোধের মুখে ইংরেজরা শেষ অবধি টিকতে পারেনি।

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র সৃষ্টি হয়। আমাদের এ জন্মভূমি পাকিস্তানের অংশ হয়ে যায় । ইংরেজদের কারণে শোষিত হওয়া এদেশ যখন নতুন রাষ্ট্র হওয়ার সুবাদে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলো, তখনি পাকিস্তানের ক্ষমতালোভী শাসকগোষ্ঠী বাংলার মানুষের উপর শোষণ- বঞ্চনা ও বৈষম্যমূলক আচরণ শুরু করে। সকল ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানিরা ভোগ করতে থাকে। ইসলাম ধর্মালম্বী মানুষের সেন্টিমেন্টকে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার চেষ্টা করলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই এদেশের মানুষ তা বুঝতে পারে। প্রথম আঘাত আসে ভাষার উপর। তীব্র আন্দোলন- সংগ্রামের মাধ্যমে এদেশের মানুষ নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে।

নানা সময়ই পাকিস্তানিরা এদেশের মানুষের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছিলো। এদেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে কোণঠাসা করে রেখেছিলো। এদেশের মানুষের স্বত:স্ফূর্ত ভোট ও সমর্থনে নির্বাচিত দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় ক্ষুব্ধ হয়ে যায় এদেশের সাধারণ জনতা। সামরিক শাসনের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানিরা আমাদের রাজনৈতিক অধিকার ও মত প্রকাশের অধিকার কেড়ে নেয়। তাই এদেশকে নতুন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার উপযোগিতা সৃষ্টি হয় । ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভাষণের মাধ্যমে এদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শুরু হয়ে যায় অসহযোগ আন্দোলন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভয় পেয়ে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ নির্বিচারে হত্যা করে এদেশের সাধারণ মানুষকে, যা ইতিহাসে পৈশাচিক গণহত্যার কালোরাত হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে। সেই রাতেই প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু এবং তারপরই তিনি গ্রেফতার হন। পরের দিন ২৬শে মার্চ থেকে শুরু হয়ে যায় রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রাম। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও অসংখ্য ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় আমাদের স্বাধীনতা।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ঘটনাপ্রবাহ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করেছিলো। এই মাসে এদেশের মানুষ স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিলো, এই মাসে কালোরাতে পাকিস্তানিরা নির্বিচারে গণহত্যা করেছিলো, এ মাসেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। তাই এদেশের ইতিহাসে এই মাসটি একটি অবিস্মরণীয় মাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

প্রতি বছর এই মাসটি আমাদের দেশে মহাসমারোহে উদযাপিত হয়। আমরা স্মরণ করি আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের কথা, স্মৃতিতে ভেসে আসে বীরদের বীরগাঁথা। বীরদের মূল্যায়ন না করলে নতুন বীর সৃষ্টি হয়না। কিন্তু, বীরদের আদর্শকে অনুসরণ করতে না পারলেও বীরদের সম্মান- মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়না। প্রতি বছর এই মাসটিতে আমরা আমাদের ইতিহাসকে স্মরণ করার পাশাপাশি নিজেদেরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাও অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে রক্ষা করা কঠিন। আজও আমাদের অপার সম্ভাবনার প্রতি লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে শত্রু, নানাভাবে কেড়ে নেয় আমাদের অধিকার। আমরা যদি এসব শত্রুর হাত থেকে দেশকে বাঁচাতে না পারি, বন্ধুরূপী শত্রুদের শনাক্ত করতে না পারি, তবে স্বাধীনতার কোনো মূল্য থাকেনা। আমরা যদি জাতি হিসেবে ঐক্যবদ্ধ থাকতে না পারি, বিশ্বের বুকে নিজেদের মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারি, তবে ব্যর্থ হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের উদ্দেশ্য ও চেতনা।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ঘটনা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে। কিন্তু কেবল মুখে স্বাধীনতার বুলি আওড়িয়ে দেশকে মর্যাদার শেখরে নেয়া যায়না। তাই গৌরবময় ইতিহাসকে স্মরণ করার পাশাপাশি আমরা যেন জাতি হিসেবে নিজেদেরকে সৎ, আদর্শ, দক্ষ, আধুনিক ও উন্নত করতে পারি, সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। যেদিন বাংলাদেশের আনাচে- কানাচে দারিদ্র্য থাকবেনা, যেদিন এদেশে অন্যায় ও দুর্নীতি থাকবেনা, যেদিন এদেশের সূর্যসন্তানদের আলোয় মুখরিত হবে সারা বিশ্ব, সেদিন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ সার্থক হবে। আমরা যদি প্রত্যেকে নিজেরা সৎ ও আদর্শ হই, দক্ষ, আধুনিক ও উন্নত হই, তবে উন্নত হয়ে যায় আমাদের জাতি। তাই আমাদের জাতিকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার শিখরে পৌঁছে দেয়ার জন্য সর্বাগ্রে আমাদের নিজেদের দক্ষতা ও নৈতিকতার উন্নয়ন জরুরী। এ কাজে সকলেরই আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। তবেই সার্থক হবে আমাদের ইতিহাস সৃষ্টিকারী মুক্তির সংগ্রাম।

Similar Posts