ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর পরিপূর্ণ গাইডলাইন

দুনিয়াজুড়ে স্বাস্থ্য সচেতনদের মাঝে জনপ্রিয় ট্রেন্ড এখন ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং। ওজন কমানো, স্বাস্থ্যের উন্নতি এবং জীবনযাত্রা সহজ করার জন্য মানুষ এখন ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর প্রতি ঝুঁকছে। দীর্ঘ সময় জুড়ে না খেয়ে থাকা অনেকের কাছে ভীষণ কষ্টকর। কিন্তু, নিয়ন্ত্রিত উপবাসের মাধ্যমে ওজন কমানো ও অতিরিক্ত ওজনের ফলে যেসব রোগব্যাধি হয় সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

Intermittent-Fasting

প্রায় সব ধর্মেই ফাস্টিং এর বিধান প্রচলিত আছে। যেমন ইসলাম, খ্রীষ্টান ধর্ম, হিন্দু ও বৌদ্ধধর্ম। তাই, আমরা সবাই ফাস্টিং এর সাথে মোটমুটি পরিচিত।

প্রচলিত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে জনপ্রিয় হলো দিনে ১৬ ঘন্টা ফাস্টিং করা। অথবা সপ্তাহে ২ বার ২৪ ঘন্টা করে না খেয়ে থাকা। আপনার দিনগুলিকে আপনি এমনভাবে ভাগ করবেন যেন, দিনের কিছু অংশ আপনি পানাহার করবেন আর দিনের বাকি অংশে অভুক্ত থাকবেন। যেমন ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৮ ঘন্টা আপনি খাবেন, আর বাকি ১৬ ঘন্টা ফাস্টিং করবেন, মানে খাবেন না।

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর পদ্ধতিগুলো

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। ফাস্টিং এর সময়টাতে খুব কম খাবেন বা কিছুই খাবেন না।

সবচেয়ে জনপ্রিয় পদ্ধতিগুলো হলো…

  • ১৬/৮ ঘণ্টা:

    এই পদ্ধতিতে সকালের নাস্তা খাবেন না। বেলা ১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খাওয়া দাওয়া করবেন। এরপর ১৬ ঘণ্টার ফস্টিং।

  • খান-থামুন-খান:

    এই পদ্ধতিতে ২৪ ঘণ্টা করে কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকুন প্রতি সপ্তাহে ১ বা ২ বার। যেমন ধরুন একদিন রাতের খাবার খেয়ে পরদিন রাতে খাবেন।

  • ৫/২ ডায়েট:

    এই পদ্ধতিতে প্রতি সপ্তাহে পরপর ২ দিন ৫০০ থেকে ৬০০ ক্যালোরির খাদ্য গ্রহণ করুন। বাদবাকি দিনগুলোতে স্বাভাবিক খাবার খান।

১৬/৮ ঘণ্টার পদ্ধতিটি সহজ বলে মনে হয় অনেকের কাছে। এটি সবচেয়ে জনপ্রিয়ও বটে।

ওজন কমানোর জন্য একটি কার্যকর কৌশল

আহার কমানোর মাধ্যমে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং আপনার ক্যালোরি গ্রহণ কমিয়ে আনে। যার ফলে ওজন কমে।

অন্যদিকে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং আপনার হরমোন লেভেলকে এমনভাবে পরিবর্তন করে যা ওজন কমাতে সাহায্য করে। এটি আপনার ইনস্যুলিন কমিয়ে গ্রোথ হরমোনকে বাড়িয়ে দেয়। পাশাপাশি চর্বি ঝরানোর হরমোন নোরাড্রেনালিন এর নি:সরণও বাড়িয়ে দেয়। গবেষণায় দেখা গেছে এর ফলে পেটের চারপাশের ক্ষতিকর চর্বি, যেগুলোর কারণে বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়, ঝরে যায়।

একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর সফলতা নির্ভর করে কম ক্যালোরি গ্রহণের উপর। আপনি যদি খাবার গ্রহণের পিরিয়ডটাতে অতিরিক্ত খেয়ে ফেলেন তাহলে কাংখিত ফল পাবেন না।

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর উপকারীতা

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর উপকারীতা নিম্নরূপ…

  • ওয়েট লস

    যেমনটা আগেই বলেছি, এই পদ্ধতিতে আপনি ওজন ও পেটের মেদ ঝরাতে পারবেন। শর্করা (ভাত/ রুটি) খাবার বিধিনিষেধ না মেনেই।

  • ইনস্যুলিন হ্রাস

    ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর ফলে রক্তের শর্করার পরিমান হ্রাস করে ৩-৬%। এবং ফাস্টিং এর সময়টাতে ইনস্যুলিন হ্রাস করে ২০-৩১%। যেটা টাইপ ২ ডায়েবিটিস প্রতিরোধ এ সহায়তা করে।

  • ব্যাথা হ্রাস

    কিছু সমীক্ষায় দেখা যায় ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর ফলে ব্যাথা নাশ হয়, যা অনেক ক্রনিক রোগের কারণ।

  • ক্যানসার প্রতিরোধ

    প্রাণীদের উপর গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং ক্যানসার প্রতিরোধ করতে পারে।

মনে রাখতে হবে, এই নিয়ে গবেষণা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। মানুষের উপর করা গবেষণায় অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি।

যারা ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এড়িয়ে যাবেন

আপনি যদি আন্ডার ওয়েট হয়ে থাকেন অথবা আপনার যদি ইটিং ডিজ-অর্ডার থেকে থাকে। তবে, চিকিৎসক এর পরামর্শ ছাড়া ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করতে যাবেন না।

সাইড ইফেক্টস

 ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর প্রধান পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ক্ষুধার তাড়না। আপনি দুর্বলতা অনুভব করতে পারেন, অথবা আপনার মস্তিষ্ক ততটা সক্রিয় নাও থাকতে পারে।

নিম্নলিখিত স্বাস্থ্য সমস্যা যদি আপনার থেকে থাকে তবে আপনি ফাস্টিং এর পূর্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন…

  • যদি ডায়াবিটিস থেকে থাকে।
  • রক্তে সুগারের তারতম্য থেকে থাকে
  • নিম্ন রক্তচাপ থাকলে
  • নিয়মিত কোন ঔষধ সেবন করেন
  • আন্ডারওয়েট হয়ে থাকেন।
  • ইটিং ডিস-অর্ডারের ইতিহাস থেকে থাকলে
  • মা হবার চেষ্টা করছেন এমন মহিলা
  • পিরিয়ড হচ্ছে না এমন মহিলা
  • গর্ভবতী ও ব্রেস্টফিডিং মা

যদি আপনি সুস্থ্য ও স্বাস্থ্যবান হয়ে থাকেন তবে মাঝেমাঝে না খেয়ে থাকার মধ্যে কোন সমস্যা নেই।

ফাস্টিং চলাকালীন আপনি যেকোন নন-ক্যালরি পানীয় পান করতে পারেন। চিনি ছাড়া অল্প দুধ দিয়ে চা-কফি পান করতে পারেন। ক্ষুধা দমনের জন্য এটি একটি কার্যকর পণ্থা। ফাস্টিং এর অবস্থায় শরীরচর্চা করতে কোন সমস্যা নেই। শিশুদের কখনও ফাস্টিং করান উচিত নয়।

কিভাবে শুরু করবেন

প্রাত্যহিক জীবনে আমরা অনেকেই ফাস্টিং করে থাকি। যেমন, অনেকে সকালের নাস্তা না করে একেবারে দুপুরের খাবার খেয়ে থাকেন। অনেকে সকালে ক্ষুধা বোধ করেন না, তাই সকালে খালিপেট থাকেন। তাই, স্বাভাবিকভাবেই প্রায় ১৬ ঘণ্টা না খেয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে ১৬/৮ ঘণ্টার পদ্ধতিটি আপনার জন্য খুবই কার্যকর। যদি আপনি না খেয়ে থাকলে কোন অসুবিধা বোধ না করেন, তো আরও এডভান্সড লেভেলের ফাস্টিং করতে পারেন। যেমন, সপ্তাহে ২ বার ২৪ ঘণ্টা করে না খেয়ে থাকা।

অথবা যখন প্রয়োজন হয় একবেলার আহার ছেড়ে দিন। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করার জন্য কোন নির্দিষ্ট ছক অনুসরণ না করলেও আপনি এর কিছু উপকার অবশ্যই পাবেন। আপনার সুবিধামত প্যাটার্ণ অনুসরণ করুন।

অনেকে প্রশ্ন করেন যে, ওজন কমানোর জন্য এই পদ্ধতিটি কিভাবে কার্যকর উপায়ে ব্যবহার করা যায়। উত্তর হলো, সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে শরীরকে আরাম দেয়া। এক্ষেত্রে, প্রয়োজন আমিষ, জটিল শর্করা ও স্নেহ পদার্থের সংমিশ্রণে এমনভাবে খাবার পরিকল্পনা করা যেন, ২৪ ঘন্টাই আপনি পর্যাপ্ত শক্তি লাভ করতে পারেন। দিনের যে কয় ঘন্টা আপনি খাবেন না, তখনও আপনি যেন কর্মক্ষম থাকেন।

এখানে এমন কিছু খাবারের তালিকা দেয়া হলো…

মাংস আমিষের ভালো উঃস
চর্বিহীন তাজা আমিষ গ্রহণ করুন
  • আমিষ

    তাজা, চর্বিহীন, প্রক্রিয়াজাত নয় এমন আমিষের উৎস বাছাই করুন। উদ্ভিজ আমিষের মধ্যে মসুর ও অন্যান্য ডাল এবং শীম জাতীয় শস্য আমিষের ভালো উৎস।

উদাহরণ: ডিম, ডিমের সাদা অংশ, মাছ, মুরগী, টার্কি, চর্বিহীন গরুর মাংস, মহিষ, বাসায় তৈরী পনীর, দই ইত্যাদি।

ভাত
ভাত, রুটি খেতে মানা নেই
  • জটিল শর্করা

    আস্ত, নূন্যতম প্রক্রিয়াজাত জটিল শর্করা বাছাই করুন যেগুলো, আশঁজাতীয় ও পুষ্টি উপাদানে ভরপুর।

উদাহরণ: মিষ্টি আলু, কচুর মুখি, শীম বরবটি, ডাল, ওট (জই), বার্লি, বাজরা, আস্ত ও অংকুরিত শস্য, চাল ও দই ।

বিভিন্ন রকম বাদাম
বিভিন্ন রকম বাদাম
  • স্বাস্থ্যকর স্নেহ

    এই তেলগুলো পাওয়া যায় বাদাম, বাদামের তেল ও মাখন, এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল ইত্যাদি থেকে।

উদাহরণ: তেল (জলপাই, আখরোট, আভোকাডো), ৬ মাসের পুরোন পনীর, ডিমের কুসুম, বীজ (তিল, তিসি, শণ,                          মিষ্টিকুমড়ার বীজ), বাদাম (চীনা, কাজু, পেস্তা, আখরোট) এবং নারিকেল ইত্যাদি।

রকমারী শাকসব্জী
সব রং এর সব্জী আহার করুন
  • শাকসব্জী

    সকল বর্ণ, গন্ধ, আকার ও রকমের সব্জী। দুমুঠো পরিমান সব্জী প্রতিবেলা আহার করুন কাঁচা, রান্না, সেদ্ধ, ভাজি, বরফে জমানো বা মাইক্রোওয়েভ্ড যেভাবেই হোক না কেন। খেয়াল রাখুন আপনার প্রতিবেলার সব্জীর অর্ধেক অংশ যেন শাক ও পাতা জাতীয় হয়।

উদাহরণ: কন্দ জাতীয় সকল সব্জী, মিষ্টি কুমড়া, চালকুমড়া, টমেটো, বেগুন, পাতাকপি, ফুলকপি, গাজর, মূলা, ব্রকোলি,              মরিচ, রসুন, ধনেপাতা, পেঁয়াজ ও পেঁয়াজের পাতা, শাক  ইত্যাদি।

দই
দই অন্ত্র ভালো রাখে
  • ফারমেন্টেড (গেঁজানো) খাবার

    ফারমেন্টেড খাবার অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। দেহের উপকারী অনুজীবের বৃদ্ধিতে এটি যেমন সাহায্য করে, তেমনি আমিষ, শর্করা, স্নেহ ইত্যাদি খাবার হযম করে শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি শোষণে সহায়তা করে।

উদাহরণ: টকদই, বাঁধাকপি, টেম্পে, কিমচি, মিজো এগুলো।

তাজা ফল
তাজা ফল খান
  • তাজা ফল

    এতে কোন দ্বিমত নেই যে, যেকোন স্বাস্থ্যকর খাবারের তালিকায় তাজা ফল থাকবেই। খাদ্যতালিকায় এমন ফল রাখুন যেগুলো কম মিষ্টি।

উদাহরণ: মিষ্টি কম এমন ফল হলো আপেল, কমলা, মাল্টা, আংগুর, আনার, জাম, আমলকি ইত্যাদি।

মনে রাখবেন খাবার সময়টাতে আপনি যদি জাংক ফুড অথবা অতিরিক্ত ক্যালরি যুক্ত খাবার খেয়ে ফেলেন তাহলে ফাস্টিং আপনার কোন কাজে আসবে না।

নিচের খাবারগুলি আপনাকে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করার সময়ে ওজন কমতে বাধা দিবে।

  • সোডা
  • এ্যালকোহল
  • ভাজা খাবার
  • অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার
  • সরল শর্করা
  • প্রদাহ বৃদ্ধিকারী তেল যেগুলো শস্যদানা থেকে প্রস্তুত হয়।
  • অতিরিক্ত ক্যাফেইন

সবার জন্য ভালো হবে এমন কোন ডায়েট পদ্ধতি নেই। আপনার জন্য সেই ডায়েট সবচেয়ে ভালো যেটা আপনি সবসময় চালিয়ে যেতে পারবেন।কিছু মানুষের জন্য ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং খুব ভালো, অনেকের জন্য নাও হতে পারে। আপনি কোন দলে, সেটা জানার একমাত্র উপায় চেষ্টা করে দেখা।যদি আপনি ফাস্টিং করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন ও চালিয়ে যেতে পারেন, তবে ওজন কমানো ও স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য এটি খুবই কার্যকর উপায়।

Similar Posts

7 Comments

Comments are closed.