মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প- ৪র্থ পর্ব

আজকের মতো এত আধুনিক যোগাযোগ মাধ্যম তখন ছিলো না । তাই মানুষ রেডিও কিংবা টেলিভিশনের সামনে অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে ছিলো । ঈগলের পৃষ্ঠে লাগানো একটি ক্যামেরা থেকে পাঠানো ছবিতে ঈগল থেকে বেরিয়ে আসা নামার মই দেখা যাচ্ছিলো ।

the-story-of-the-lunar-conquest-of-man

কিছুক্ষণ পরেই দৃশ্যপটে নীল আর্মস্ট্রংকে অস্পষ্টভাবে দেখা গেলো । সেই সঙ্গে অনেক পথ পেরিয়ে পৃথিবীতে আসছে তার যান্ত্রিক কণ্ঠ । যদিও তিনি কী বলবেন, সেটা আগে থেকেই নাসার পক্ষ হতে ঠিক করে দেয়া হয়েছিলো । মই থেকে নামা শুরু করলেন আর্মস্ট্রং । বিশ্ববাসী তখন উত্তেজনায় থর থর, যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেছে । সিড়ি বেয়ে আস্তে আস্তে নিচে নামতে থাকলেন নীল । শেষ ধাপে এসে ক্ষণিকের জন্য তিনি থামলেন । অজানা জায়গায় প্রথম বারের মতো পা রাখতে যাচ্ছে মানুষ । কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না তো ? অজানা এক ভয় পাচ্ছিলেন টিভি সেটের সামনে বসে থাকা দর্শকরাও ।

তবে যদি সত্যিই ভয়ংকর কোনো বিপদ ঘটে, তার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলো নাসা । আমেরিকার প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে একটি শোক বার্তা তৈরি করে রাখা হয়েছিলো । তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন আগে থেকেই একটি শোক বার্তা রেকর্ড করে রেখেছিলেন টেলিভিশনে প্রচারের জন্য । নাসা মহাকাশীয় পদ্ধতিতে নভোচারীদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে একজন পাদ্রীকে ঠিক করে রেখেছিলো । কিন্তু, পরে এই ব্যবস্থাগুলোর প্রয়োগ আর করতে হয়নি ।

সব ভয়কে জয় করে চাঁদের বুকে মিহি ধুলোয় নিজের পায়ের ছাপ এঁকে দিলেন নীল আর্মস্ট্রং, চাঁদের বুকে পা রাখা প্রথম মানুষ । সেই সাথে নেমে এলেন অলড্রিন-ও ।

চন্দ্রপৃষ্ঠে বাজ অলড্রিন, ছবিটি তুলেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং ।
চন্দ্রপৃষ্ঠে বাজ অলড্রিন, ছবিটি তুলেছিলেন নীল আর্মস্ট্রং ।

তারপর তাঁরা চাঁদে যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা পুঁতে দেন । নিহত হতভাগ্য অভিযাত্রীদের ছবি, মেডেল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট সহ ৭৩টি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের শুভেচ্ছাবার্তা রেখে দেন চাঁদের বুকে । তারপর তাঁরা চাঁদে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন, বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করেন এবং নির্ধারিত সময়ে মহাকাশ যানে চলে আসেন । তাঁরা চাঁদের বুকে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় কাটান । তখন কমান্ড মডিউল পাইলট কলিন্স কলম্বিয়াকে তথা কমান্ড মডিউলকে চাঁদের কক্ষপথে চালিয়ে যাচ্ছিলেন একাই । তিনি চাঁদে সরাসরি না নামলেও এই অভিযানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন । তাঁকে এমন পরিস্থিতির জন্য আগে থেকেই মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিলো ।

অভিযান সফল হওয়ার পর এবার ঘরে ফেরার সময় । বিজয়ীর বেশে পৃথিবীর পথে ফিরতে শুরু করেন তিন অভিযাত্রী । তিন দিন পর অর্থাৎ ২৪ জুলাই তাদের মহাকাশযান পৃথিবীর কক্ষপথে ফেরত আসে । কিছু সময় পরে প্রশান্ত মহা সাগরের বুকে তিনটি প্যারাসুটে ভর করে নেমে আসে । পৃথিবী থেকে যাওয়ার প্রায় ১৯৫ ঘন্টা ১৮ মিনিট পর ফিরে আসেন তিন নভোচারী । আমেরিকার নৌবাহিনীর ‘ইউএসএস হর্নেট’ নামক নৌতরী তাঁদেরকে হাওয়াই উপকূল থেকে উদ্ধার করে । দেশে ফেরার পর তাঁরা যথোপযুক্ত সম্মান পান ।

দেশে ফেরার পর তাঁদেরকে একটি বদ্ধ কেবিনে প্রায় ৩ সপ্তাহের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছিলো । চাঁদ থেকে কোনো অজানা ভাইরাস তাঁদের শরীরে চলে এসেছিলো কিনা, সেই আশঙ্কা করা হয়েছিলো । পরবর্তীতে তাঁরা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক জীবন যাপনে ফিরে আসেন । তারপর বিজয়ীর বেশে ডাকঢোল পিটিয়ে তাঁরা বিশ্ব ভ্রমণে বের হন । তাঁরা ঢাকায়ও আসেন ভ্রমণের অংশ হিসেবে ।

এভাবেই চাঁদের বুকে প্রথম বার সফলভাবে মানব পদ চিহ্ন রাখার মাধ্যমে স্নায়ুযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের রাইভাল সোভিয়েত ইউনিয়নকে মহাকাশ প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দেয় । পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন মানুষকে বোঝাতে চেয়েছিলো- যুক্তরাষ্ট্র যেটা মানুষ পাঠিয়ে করে, সোভিয়েত সেটা যন্ত্র দিয়ে কম খরচে করে ফেলে । কিন্তু, চাঁদে মানুষের পা রাখার সাথে বিশ্ববাসীর যে আবেগ মিশ্রিত ছিলো, তার কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের এই পরিকল্পনা ধোপে টিকেনি ।

তারপর আরো ৫ বার নাসা চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিলো, আরও দশ জন নভোচারী চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিলেন । কিন্তু অধিকাংশ মানুষ শুধু প্রথমকেই মনে রাখে । তাই নাসার অন্যান্য চন্দ্র অভিযানের থেকে অ্যাপোলো – ১১ এর অভিযান বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলো । নীল আর্মস্ট্রং, বাজ অলড্রিন আর মাইকেল কলিন্স আজ থেকে ৫০ বছর আগে যে দুঃসাহসী অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন, তা আজও বিশ্ববাসীর কাছে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসেবে স্মৃতিময় হয়ে আছে । মঙ্গল গ্রহে পা দেওয়ার আগ পর্যন্ত সেটা বহাল থাকবে, সে আশা বেশ জোরের সাথেই করা যায় ।

অন্যান্য পর্বসমূহ : 

মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প-  ১ম পর্ব
মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প- ২য় পর্ব
মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প- ৩য় পর্ব

তথ্যসূত্র:

১৯৬৯: দ্য ইয়ার এভরিথিং চেঞ্জড/রব কির্কপ্যাট্রিক, স্কাইহর্স পাবলিশিং, ২০০৯
অ্যাপোলো ১১/ডেভিড হোয়াইটহাউজ, আইকন বুকস, ২০১৯
বিবিসি স্কাই অ্যাট নাইট ম্যাগাজিন, আগস্ট ২০১৯
বিজ্ঞানচিন্তা, জুলাই ২০১৯
মহাকাশে মানুষ/প্রদীপচন্দ্র বসু, আনন্দ পাবলিশার্স, ২০১৫

Similar Posts