মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প- ৩য় পর্ব

প্রেসিডেন্ট কেনেডির ঘোষণার পর, এভাবেই সুদীর্ঘ আট বছর ধরে চলা চাঁদে অবতরণের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো । এবার চলে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুলাই । অ্যাপোলো – ১১ মানব ইতিহাসে দুঃসাহসিক অভিযানে যাত্রা শুরু করে । তিন জন নভোচারী- লুনার মডিউল পাইলট বাজ অলড্রিন, কমান্ড মডিউল পাইলট মাইকেল কলিন্স এবং কমান্ডার নীল আর্মস্ট্রং রকেটের মাথায় চড়ে বসলেন ।

the-story-of-the-lunar-conquest-of-man

অ্যাপোলো – ১১ যুক্তরাষ্ট্রের সময় অনুযায়ী চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছে ১৯ জুলাই । পরের দিন তথা ২০ জুলাই ভূপৃষ্ঠ ছেড়ে যাওয়ার একশ ঘণ্টা বারো মিনিট পরে কমান্ডার নীল আর্মস্ট্রং এবং লুনার মডিউল পাইলট বাজ অলড্রিন কলাম্বিয়া (কমান্ড মডিউল) থেকে ঈগলে (লুনার মডিউল) প্রবশে করেন । এবার তাদের গন্তব্য হলো চাঁদের পৃষ্ঠ।

ঈগল ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ণ এক নভোযান । প্রায় ১৬শ কেজি ভরের এই নভোযানের ওপর তলায় দুই অভিযাত্রীর থাকার জায়গা ছিলো । এই নভোযানটি এমনভাবে বানানো হয়েছিলো, যেন মহাকাশের তাপমাত্রার চরম পার্থক্যের মধ্যেও তার প্রভাব নভোযানে না পড়ে এবং ছোটখাটো দুর্ঘটনাতে অকেজো না হয়ে পড়ে ।

অ্যাপোলো-১১ এর তিন জন নভোযাত্রী
অ্যাপোলো-১১ এর তিন জন নভোযাত্রী ।

প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে চাঁদের কক্ষপথ থেকে বেশ মসৃণ গতিতে তারা চাঁদের মাটির দিকে নামতে থাকেন । আগের অ্যাপোলো-১০ অভিযানে অবতরণ স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিলো । ঈগলের নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতির দিকে তীক্ষ্ম নজর রাখছিলেন লুনার মডিউলের পাইলট বাজ অলড্রিন । অপর দিকে, আর্মস্ট্রংয়ের নজর তখন চন্দ্র পৃষ্ঠের দিকে । তিনি সুবিধাজনক অবতরণ স্থানের খোঁজ করছিলেন । চাঁদের অভিকর্ষের টানে লুনার মডিউল- ঈগল ক্রমেই নিচের দিকে নামছে । আর মাত্র ৫ মিনিট বাকি চন্দ্রপৃষ্ঠে নামার ।

এমন সময় চন্দ্রভেলায় তথা লুনার মডিউলে একটি বিপদ সংকেত বেজে উঠলো । নভোযানের কম্পিউটার ১২০২ কোড দেখিয়ে এরর দেখালো । ঈগল থেকে চন্দৃপৃষ্ঠের দূরত্ব তখন মাত্র নয় হাজার মিটার । কিন্তু, অলড্রিন কিংবা আর্মস্ট্রংও বুঝতে পারলেন না সেটা কীসের সংকেত । যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের গ্রাউন্ড কন্ট্রোলের কাছেও বিষয়টি বোধগম্য হলো না । একেবারে শেষ সময়ে চাঁদের এত কাছে এসে কি তাদের ফিরে যেতে হবে ? শেষ সময়ে ফিরে যাওয়ার চেষ্টাও বিপদ ডেকে আনতে পারে । সেসময় মিশন কন্ট্রোল তাদের ম্যানুয়াল আঁতিপাতি করে দেখছে ১২০২ এরর কোডের মানে বুঝতে । এর মধ্যেই ঈগলে দ্বিতীয় আরেকটি বিপদ সংকেত বেজে উঠলো । মিশন কন্ট্রোল তখন অন্যরকম এক উত্তেজনায় ভুগছিলো । কিন্তু, অভিযাত্রীদের মাথায় তখন অন্য চিন্তা । গোটা পৃথিবী এখন তাদের দিকেই চেয়ে আছে ।

ঈগলের কন্ট্রোল প্যানেলের দিকে তাকিয়ে অলড্রিন তখন বোঝার চেষ্টা করছিলেন বিপদ সংকেতের উৎস । এদিকে নীল আর্মস্ট্রং পড়েছেন বিপদে । বিপদ সংকেত নিয়ে ব্যস্ততার কারণে নির্ধারিত অবতরণ স্থান পার হয়ে গেছেন তারা । নিচে যে জায়গা দেখা যাচ্ছে, সেখানে নামলে চাঁদের মাটিতে ঈগল আছড়ে পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে । অন্যদিকে, ফুয়েল ইন্ডিকেটরে দেখা যাচ্ছে, চাঁদের মাটিতে নামতে ঈগলের জ্বালানি ট্যাংকে আর মাত্র ৬০ সেকেন্ড এর জ্বালানি রয়েছে ! এর মধ্যে তাদের সেখানে নামতে হবে, নয়তো এত কাছে এসেও ফিরে যেতে হবে ।

তখন আর্মস্ট্রং ঈগলের জানালা দিয়ে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে অবতরণের জন্য একটি জায়গা ঠিক করে ফেললেন । ৩০ সেকেন্ডের জ্বালানি বাকি থাকতেই বাজ অলড্রিন চাঁদের মসৃণ ভূমিতে অবতরণ শুরু করলেন । মাটির কাছে যেতেই ঈগলের ইঞ্জিন থেকে তীব্র বেগে বেরিয়ে আসা গ্যাসের ধাক্কায় চারদিক ধুলোয় ধূসর হয়ে গেলো । এতে করে অবতরণজনিত ঘর্ষণকে হ্রাস করা হয় । চারদিকে ধুলোর কারণে শেষ কয়েক মিটার অবতরণে ঈগলের ভাগ্যে কী ঘটলো, সে বিষয়ে আর্মস্ট্রং এবং অলড্রিন পুরোপুরি অন্ধকারে রইলেন । কিছুক্ষণ পর যখন কন্ট্রোল প্যানেল থেকে নীল আলো জ্বলে উঠলো, তখন তারা নিশ্চিত হলেন যে, তাঁরা সত্যিই চাঁদে অবতরণ করেছেন । নীল আলো জ্বলার পর হিউস্টনের কন্ট্রোল প্যানেলের কর্মীরাও যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ।

যুক্তরাষ্ট্রের হিসেব অনুযায়ী তখন ২০ জুলাই । পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অলড্রিন এবং আর্মস্ট্রং কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিলেন । আধোঘুম আর উত্তেজনায় সেই কয়েক ঘণ্টা তাদের কাছে কয়েক বছরের সমান মনে হলো । ঘণ্টা চারেক বিশ্রাম নিলেন তাঁরা । তারপর ঘনিয়ে এলো সেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত ।

অন্যান্য পর্বসমূহ : 

মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প-  ১ম পর্ব
মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প- ২য় পর্ব
মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প- ৪র্থ পর্ব

Similar Posts