মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প- ২য় পর্ব
রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রেসিডেন্ট জন কেনেডির বক্তব্যের পরে পুরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে যেন সাজ সাজ রব পড়ে গেলো । চাঁদে মানুষ পাঠানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা – নাসা ও ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে । শুরু হয়ে যায় ‘অ্যাপোলো’ নামের নতুন একটি প্রজেক্ট । এর নামকরণ করেছিলেন নাসার ম্যানেজার অ্যাবে সিলভারস্টাইন । ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে নিজ বাড়িতে একদিন সন্ধ্যার সময় নামটি দেওয়ার কথা হঠাৎ করেই তার মনে হয় । অ্যাবের কাছে মনে হয়েছিল, অ্যাপোলো তার রথে চেপে যেভাবে যাতায়াত করে থাকে, নাসার প্রস্তাবিত বড় ধরনের এই প্রজেক্টের জন্য এর চেয়ে উপযুক্ত নাম আর কিছুই হতে পারে না ।
অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট কেনেডি কেবল ঘোষণা দিয়েই খালাস । যখন আমেরিকা চাঁদে মানুষ পাঠানোর কথা ভাবছিলো, তখন মার্কিনিদের সত্যিকার অর্থেই সে ক্ষমতা কিংবা কারিগরী সক্ষমতা কিছুই ছিলো না । আজকের মতো উন্নত প্র্রযু্ক্তি, স্পেসস্যুট, রকেট এমনকি অন্যান্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির কিছুই মার্কিনিদের কাছে ছিলো না ।
কোন পথে, কীভাবে যেতে হবে, যাত্রা পথে কী কী বাধার মোকাবেলা করতে হবে- এসব বিষয়েও কোনো তথ্য ছিলো না আমেরিকার গবেষক ও বিজ্ঞানীদের কাছে । এরকম আরো অনেক অজানা, বাধা এবং সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও কেবল প্রচণ্ড ইচ্ছা শক্তির উপর ভর করে মাত্র নয় বছরের মাথায় এই অসম্ভব কর্মকে সম্ভব করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মানব ইতিহাসে এক নজির সৃষ্টি করে তারা । কিন্তু, ইতিহাসে এই গুরুত্বপূর্ণ বিজয়ের ঘটনাটি নিজ চোখে দেখে যেতে পারেন নি প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি । ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ শে নভেম্বর তারিখে এক আততায়ীর গুলিতে মারা যান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি । কেনেডির স্মরণে ১৯৬৩ সালে ফ্লোরিডায় নাসার রকেট উৎক্ষেপন কেন্দ্রের নামকরণ করা হয় কেপ কেনেডি । এই কেন্দ্র থেকেই অ্যাপোলো প্রজেক্টের প্রথম মানুষবাহী কর্মসূচী শুরু করার পরিকল্পনা করা হয় ।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ২১ শে ফেব্রুয়ারি তারিখে তিন জন নভোচারীকে নিয়ে একটি মহড়ার আয়োজন করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা- নাসার পক্ষ থেকে । কিছুদিন পর অ্যাপোলো – ১ এ চড়ে পৃথিবীর নিম্ন কক্ষপথ পরীক্ষা- নিরীক্ষা করে দেখা হবে । ২১ শে ফেব্রুয়ারির দিন এরই মহড়ায় অংশ নেন তিন জন নভোচারী । তাঁরা হলেন এডওয়ার্ড হোয়াইট, ভার্জিল গ্রিসম এবং রজার চ্যাফফি । রকেটের মাথায় বসানো কমান্ড মডিউলে অভিযানের চূড়ান্ত মহড়া চলছিলো ।
কাজ শুরু হওয়ার পর প্রথম দিকেই বৈদ্যুতিক তার থেকে আগুনের স্ফূলিঙ্গ দেখা দেয় । রকেটের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে বিশুদ্ধ অক্সিজেনের সরবরাহ থাকার কারণে মুহূর্তের মধ্যে আগুন দাউ দাউ করে চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে । নিয়ন্ত্রণ কক্ষের দাহ্য পদার্থ দিয়ে বানানো বিভিন্ন জিনিসে ও যন্ত্রপাতিতে মুহূর্তের মধ্যেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে । তিন নভোচারী চোখের পলকেই পুড়ে গিয়ে কয়লা হয়ে যান । সেই সাথে সেদিন নিহত হন নাসার আরো সাতাইশ জন কর্মী ।
চাঁদে মানুষ পাঠানোর অভিযানের শুরুতেই এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনা অ্যাপোলো মিশনের জন্য এক বিরাট ধাক্কা হিসেবে কাজ করে । আশঙ্কা করা হচ্ছিলো যে, কাজের শুরুতেই বুঝি অ্যাপোলো মিশন শেষ হয়ে গেলো । কিন্তু, সেটি না করে নাসা তাদের কাজে আরো দৃঢ় হয়ে উঠলো । নভোচারীদের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় বিজ্ঞানী ও গবেষকগণ আরো কড়াকড়ি আরোপ করলেন । তারপর তাঁরা অ্যাপোলো ৬ পর্যন্ত মানুষ বিহীন মিশন পরিচালনা করেন । এগুলোর মধ্য দিয়ে নিরাপত্তা সহ আরো অনেক বিষয় নিয়ে নাসা প্রচুর পরীক্ষা- নিরীক্ষা এবং গবেষণা করে । তাই অ্যাপোলো – ১ এ অগ্নিকাণ্ডের পর এই মিশনে তেমন কোনো দুর্ঘটনা আর ঘটেনি ।
১৯৬৮ সালের ১১ অক্টোবর তারিখে নাসা থেকে পৃথিবীর কক্ষপথে অ্যাপোলো – ৭ নামক মহাকাশযান পাঠানো হয় । প্রায় ১ সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে কক্ষপথে থাকার পর অ্যাপোলো – ৭ অক্টোবরের ২২ তারিখে ভূপৃষ্ঠে ফিরে আসে । নাসার জন্য এই মিশনটিও একটি মাইলফলক ছিলো । কারণ Crue members এর মাধ্যমে রকেটের Service ও Command Module এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলোর ব্যাপারে আরো ভালো ধারণা অর্জন করতে পেরেছিলেন । সেই সাথে মহাকাশে যন্ত্রের সাথে মানুষের একত্রে কাজ করার এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতাও অর্জিত হয়েছিলো ।
অ্যাপোলো – ৭ এ সফল হওয়ার পর প্রথম চন্দ্র অভিযান চালানো হয়, অ্যাপোলো – ৮ । এটা অ্যাপোলো প্রজেক্টের দ্বিতীয় মানুষবাহী অভিযান ছিলো । এর সফলতার উপর বহু কিছু নির্ভর করছিলো । প্রথম বারের মতো এই অভিযানেই মানুষ পৃথিবীর কক্ষপথ হতে চাঁদের কক্ষপথে যেতে সমর্থ হয় । এটি ছিলো তখন পর্যন্ত পৃথিবী থেকে সবচেয়ে দূরের মহাকাশ অভিযান । তিন জন নভোচারীকে নিয়ে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ২১ শে ডিসেম্বর তারিখে যাত্রা শুরু করে অ্যাপোলো – ৮ । চাঁদের চার পাশে দশ বার চক্কর খায় নভোযানটি । ছয় দিন পর ডিসেম্বরের ২৭ তারিখে পৃথিবীতে ফেরত আসে অ্যাপোলো – ৮ নভোযান । পরবর্তী চন্দ্র অভিযানগুলোকে এই মিশনটিই পথ দেখিয়েছিলো ।
চাঁদে অভিযান নিয়ে নাসার এমন কর্মকাণ্ডের সময় রাশিয়া শুক্র গ্রহে ভেনেরা – ৬ নামের একটি অনুসন্ধানী যান পাঠায় । তাদের পরিকল্পনা ছিলো, বিশ্বাবাসীকে দেখানো, আমেরিকা যেটা মানুষ পাঠিয়ে করে, তারা যন্ত্র দিয়েই সেটা কম খরচে করে ফেলতে পারে । পরবর্তীতে তাদের এই পরিকল্পনা খুব বেশি একটা ফলপ্রসু হয়নি ।
১৯৬৯ সালে ৩রা মার্চ তারিখে কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে নাসা চাঁদে অ্যাপোলো – ৯ অভিযান চালায় । দশ দিনের এই অভিযানে চাঁদের মাটিতে অবতরণ করার জন্য প্রথম মানুষবাহী এলইএম বা লুনার এক্সকারসন মডিউল বা চন্দ্রভেলার পরীক্ষা চালানো হয় । স্বয়ংসম্পূর্ণ নতুন স্পেসস্যুটের পরীক্ষাও চালানো হয় এই মিশনে । ১৩ মার্চ অ্যাপোলো-৯ মহাকাশ যানটি পৃথিবীতে ফেরত আসে ।
একই বছরের ১৮ মে তারিখে চাঁদের কক্ষ পথে অ্যাপোলো – ১০ মহাকাশ যান পাঠানো হয় । মূল চন্দ্রাভিযান তথা অ্যাপোলো মিশনের মাত্র ২ মাস আগে অ্যাপোলো ১০ কে পাঠানো হয় সব ফাংশনালিটি এবং সিস্টেম শেষ বারের মতো চেক করে দেখে নেয়ার জন্য । অ্যাপোলো – ১০ চাইলে চাঁদের মাটিতে অবতরণ করতে পারতো । কিন্তু, তাদেরকে আগে থেকেই এ ব্যাপারে কড়াভাবে নিষেধ করে দেয়া হয়েছিলো । এই অভিযানে কমান্ড মডিউল থেকে লুনার মডিউল বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এবং তারপর আবার তাদের সংযুক্ত করে পরীক্ষা করে দেখা হয় ।
অন্যান্য পর্বসমূহ :
মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প- ১ম পর্ব
মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প- ৩য় পর্ব
মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প- ৪র্থ পর্ব