মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প- ১ম পর্ব

সাহিত্যে চাঁদের কথা এসেছে বহুবার । চাঁদের বুড়ি কিংবা ‘আয় আয় চাঁদ মামা’ ছড়া শোনার মাধ্যমে অথবা বিস্তৃত আকাশে চাঁদের ভঙ্গিমা দেখার মাধ্যমে ছোট বেলা থেকেই চাঁদ নিয়ে আমাদের মনে অন্য রকম এক আগ্রহ কাজ করে ।

the-story-of-the-lunar-conquest-of-man

জনৈক কবি লিখেছিলেন-

প্রতিদিন চাঁদ নেমে আসে
আমার জানালার পাশে ।
ঘুম ঘুম চোখ দুটি ভাসে
শুন্য গগন রাতের আকাশে ।
দূর থেকে যদি ডাকে তারা
রাত ঘুমাবে হয়ে দিশেহারা ।
যতটুকু রাত বয়ে যায় বাকি
চাঁদ নিয়ে একা জেগে থাকি ।
আঁধার জমিয়ে রাখে কালো
জোছনায় ভেসে যায় আলো ।
স্বপ্নের দিন কাটে বসন্ত উচ্ছ্বাসে
মরা কটাল তটিনী যোয়ারে ভাসে ।
আঁধার ঘুচিয়ে দিলে জীবনের আস্বাদ
জানালার পাশে তুমি পূর্ণিমার চাঁদ ।

এই আগ্রহ থেকেই মানুষ চন্দ্র জয়ের স্বপ্ন দেখে ।  কিন্তু, তৎকালীন সময়ে আজকের আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিলো না । তার উপর মহাকাশ বিজ্ঞানও তখন খুব বেশি উন্নত ছিলো না । তা সত্ত্বেও প্রযুক্তিগত, কারিগরী ও বৈষয়িক সকল সীমাবদ্ধতা এবং বাধাকে অতিক্রম করে মানুষ চন্দ্র জয় করেছে, চাঁদের বুকে পা রেখেছে । তবে এই বিজয় এক দিনে অর্জন হয় নি । কয়েক যুগ ধরে ধারাবাহিক ও অক্লান্ত পরিশ্রম, গবেষণা ও বহু নভোচারীর জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে এই বিজয় । আজকের এই ধারাবাহিক প্রবন্ধে আমরা মানুষের চন্দ্র বিজয়ের গল্পগুলো জানার চেষ্টা করবো ।

অ্যাপোলো – ১১ মিশনের মাধ্যমে ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে চাঁদের মাটিতে সর্বপ্রথম পা রাখে মানুষ। তবে এর আগে এই মিশনের প্রস্তুতি হিসেবে বহু অভিযান পরিচালনা করেন মহাকাশ বিজ্ঞানীরা ।

যুক্তরাষ্ট্র সর্বপ্রথম চাঁদে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা নেয় । এ কাজ যতটা না বৈজ্ঞানিক গবেষণার স্বার্থে করা হয়েছিলো, তার চেয়েও বেশি করা হয়েছিলো রাজনৈতিক স্বার্থে । মহাকাশ গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রকে বার বার হারিয়ে দিচ্ছিলো প্রতিদ্বন্দ্বী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা আজকের রাশিয়া ।

মহাকাশে প্রথম স্যাটেলাইট পাঠায় রাশিয়া । সেই স্যাটেলাইট তথা স্পুটনিক – ১ পৃথিবীর কক্ষপথে থেকে যখন আমেরিকার আকাশে উড়ে এবং আলোক সংকেত দিতে থাকে, তখন সমগ্র মার্কিন জনগণের পক্ষে হা করে দেখা ছাড়া আর কিছু করার ছিলো না । তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন মহাকাশে ‘লাইকা’ নামের একটি কুকুরকে প্রেরণ করে । ফলে প্রথম প্রাণী প্রেরণের কৃতিত্বও সোভিয়েত ইউনিয়নের । ১৯৬১ সালে প্রথম মানুষ হিসেবে মহাকাশ ভ্রমণ করেন ইউরি গ্যাগারিন । এই কৃতিত্বও রাশিয়ার । সারা বিশ্বে রাশিয়ার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে, তার মানে ছড়িয়ে পড়ে সমাজতন্ত্রের জয়ধ্বনি । Vostok – 6 নামক একটি মহাকাশযানে করে ১৯৬৩ সালের ১৬ ই জুন তারিখে মহাকাশে যান প্রথম নারী এবং সেই সাথে প্রথম বেসামরিক নাগরিক ভ্যালেন্টিনা টেরেসকোভা । এই অর্জনও ছিনিয়ে নেয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা আজকের রাশিয়া । লুনা – ২ নামের একটি নভোযান প্রথম চাঁদের মাটিতে নামে । এই কৃতিত্বও সোভিয়েত ইউনিয়নের ।

স্পুটনিক-১
রাশিয়ার পাঠানো স্পুটনিক-১, যা মার্কিনিদের উত্তেজিত করে তোলে ।

সোভিয়েত ইউনিয়নের তুলনায় আমেরিকার অর্জন ছিলো প্রায় শূন্য । যুক্তরাষ্ট্রও এরপর বহু নভোযান প্রেরণ করেছে । কিন্তু, বিশ্ববাসীর কাছে সেটি রাশিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ ছাড়া আর কিছুই নয় । কারণ, মানুষ সব সময়ই অগ্রজকে স্মরণ রাখে, অনুজকে নয় । চারদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের জয় জয়কারের সাথে সাথে ছড়িয়ে পড়েছিলো রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের জয়ধ্বনি । পুঁজিবাদী আমেরিকার জনগণ এই জ্বালা কতক্ষণই বা সইতে পারে ? সমাজতন্ত্রের কাছে পরাজয় মেনে নেওয়া কোনো মার্কিনির কাছেই সম্ভব হচ্ছিলো না । ফলে মার্কিন জনগণের মনে অপমান, ক্ষোভ ও প্রতিবাদ দানা বাঁধতে থাকে । এই ক্ষোভের ফলাফল তীব্রাকারে দেখা যায় ১৯৬০ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া মার্কিন নির্বাচনে ।

প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারকে নির্বাচনে হারিয়ে ক্ষমতায় চলে আসেন জন এফ কেনেডি । জন এফ কেনেডি মার্কিনবাসীর মনের ক্ষোভ এবং প্রতিবাদী মনোভাব বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন। মহাকাশ গবেষণায় আরও জোর দেওয়ার কথা বলে এবং প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ারকে খুব সহজেই হারিয়ে দিয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন জন এফ. কেনেডি । তিনি গভীরভাবেই অনুধাবন করেছিলেন যে, মহাকাশ গবেষণায় কিংবা মহাকাশ প্রতিযোগিতায় যেকোনো মূল্যে সমাজতন্ত্রের বাহক তথা সোভিয়েত ইউনিয়নকে টেক্কা দিতে হবে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ইতিহাস সৃষ্টি করার মত কিছু করে দেখাতে হবে । ইতোমধ্যেই মহাকাশ গবেষণার প্রায় সব গুলো ক্ষেত্রে প্রথম হয়ে বসে আছে সোভিয়েত ইউনিয়ন । তাই তাদের টেক্কা দিতে সরকারি দপ্তরে চলতে থাকে নানা রকম পরিকল্পনা, বাক – বিতণ্ডা । অনেক বাক – বিতণ্ডা শেষে জন এফ কেনেডি বেয়াড়া সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরাজিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন ।

চাঁদে মানুষ পাঠিয়েই বেয়াড়া সোভিয়েত ইউনিয়ন তথা রাশিয়াকে উচিত জবাব দেওয়া যাবে – এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেন প্রেসিডেন্ট জন এফ . কেনেডি । কংগ্রেসের এক যৌথ অধিবেশনে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ শে মে তারিখে প্রেসিডেন্ট কেনেডি ঘোষণা করেন যে, “আমার বিশ্বাস, এই দশক সমাপ্ত হওয়ার পূর্বেই চাঁদের মাটিতে মানব সন্তান পাঠিয়ে তাকে নিরাপদে পৃথিবীতে ফেরত আনা, মার্কিন জাতির এই লক্ষ্য অর্জন করতে শপথ করা উচিত ।”

প্রেসিডেন্ট কেনেডি এই ঘোষণা দেয়ার পরই বাস্তবিকভাবে মহাকাশ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে । এই কাজে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করা হয় । প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলার বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয় এ কাজে । যা তখনকার সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপির আড়াই শতাংশ । এই বাজেট বরাদ্দ দেয়া হয় টানা দশ বছর । এক শ্রেণির মার্কিন নাগরিক এতে ক্ষোভে ফেটে পড়েন । কিছু গবেষক ও বিজ্ঞানীও তাদের সাথে যোগ দিলেন । তাদের মতে, শুধুমাত্র প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্যে এত সম্পদ ব্যয় করার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই । এর পরিবর্তে ক্যানসার বা অন্য আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজে অর্থ বরাদ্দ হলে জনগণের উপকার হবে । বলা বাহুল্য, প্রেসিডেন্ট কেনেডির বিরোধীদের উস্কানিতে এই সমালোচনা ভালোই জমে উঠলো । বাস্তবিক অর্থেও, এত বড় মিশন পরিচালনা করার মতো পর্যাপ্ত সক্ষমতা তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ছিলো না ।

সমালোচনা কিছুটা তীব্র আকার ধারণ করতেই প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এর জবাব দিতে বাধ্য হলেন । ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ই সেপ্টেম্বর তারিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনের রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে নাসার মানুষবাহী স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের উদ্বোধন করতে যান প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি । সেখানেই তিনি সমালোচনার জবাবটা দেন । সেখানে সেই দিন প্রায় চল্লিশ হাজার জনতা উপস্থিত ছিলো । জনতার মঞ্চে দাড়িয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে প্রেসিডেন্ট কেনেডি বলেন যে, “অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, আমরা চাঁদে কেন যাবো? কেন আমরা এমন লক্ষ্য ঠিক করেছি ? তারা এটাও জিজ্ঞাসা করে বসতে পারে, সর্বোচ্চ পর্বত চূড়ায় আমরা কেন আরোহণ করি ? কেন পয়ত্রিশ বছর আগে, প্লেনে আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছি ? এ দশকে আমরা চাঁদে যেতে চেয়েছি …. চাঁদে যেতে চেয়েছি ….. চাঁদে যেতে চেয়েছি ।”

প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি
রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ে জনতার সামনে বক্তব্য রাখছিলেন প্রেসিডেন্ট কেনেডি।

প্রেসিডেন্ট জন কেনেডির বক্তব্য সমাপ্ত হওয়ার আগেই প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষের হর্ষধ্বনি এবং তুমুল করতালিতে ফেটে পড়লো গোটা এলাকা । সেই দৃপ্ত কণ্ঠ আর জনতার গর্জনে এক তুড়িতেই খড়কূটার মতো উড়ে গেলো চাঁদে অভিযানের বিপক্ষীয় সকল সমালোচনা, অনেকটাই দমে গেলেন চন্দ্র অভিযানের সমালোচকরা ।

অন্যান্য পর্বসমূহ :

মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প- ২য় পর্ব
মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প- ৩য় পর্ব
মানুষের চন্দ্রবিজয়ের গল্প- ৪র্থ পর্ব

Similar Posts