উষ্ণ জলের ঝর্ণা- আমেরিকার আরকানসাস অঙ্গরাজ্য ভ্রমণ (প্রথম অংশ)
গ্রীষ্মের এক সাপ্তাহিক ছুটিতে আরকানসাসে যাওয়া ঠিক হল। আরকানসাস প্রাকৃতিক রাজ্য বা Natural State হিসেবে সুখ্যাত কারণ এখানে সবুজের পরিমাণ অনেক বেশি। বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে থাকা পাহাড় আর সেই সাথে অরণ্যানী, তাদের মাঝে দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, ঝর্ণা, লেক এসব কিছু মিলিয়ে আরকানসাসের প্রকৃতি সত্যিই খুব দৃষ্টিনন্দন। অনেকগুলো স্টেট পার্ক সেখানে আছে যেগুলো এইসব ঝর্ণা, লেক এবং পাহাড়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে আর এই রাজ্যে স্টেট পার্কের সংখ্যা অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় বেশি।
![হট স্প্রিং ন্যাশনাল পার্ক](https://banglavibe.com/wp-content/uploads/2020/12/IMG_20190629_173012-scaled.jpg)
তবে আমাদের ভ্রমণের প্রধান আকর্ষণ ছিল উষ্ণ জলের ঝর্ণা বা হট স্প্রিং ন্যাশনাল পার্ক। ঝর্ণার অবস্থান যে শহরে সেই শহরের নামও হট স্প্রিং। আমেরিকায় বেশ কিছু জায়গাতে হট স্প্রিং থাকলেও ন্যাশনাল পার্ক শুধুমাত্র এখানের এই উষ্ণ ঝর্ণাকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে। এই ঝর্ণাগুলো একটু ভিন্ন প্রকৃতির। কোনরকম আগ্নেয় ক্রিয়া নয় বরং পৃথিবীর অভ্যন্তরের উচ্চ তাপমাত্রা এই ঝর্ণার জলকে উষ্ণ করে তোলে। বৃষ্টির জল আরকানসাস রাজ্য জুড়ে থাকা উয়াচিতা পাহাড়ের ফাটল বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামতে থাকে। জলের এই নিম্নমুখী যাত্রায় অনেক সময় লাগে, কোন কোন ক্ষেত্রে কয়েক হাজার বছর; কারণ মাটির অনেক গভীরে পর্যন্ত সেটা যায় যেখানে তাপমাত্রা অনেক অনেক বেশি থাকে। এই যাত্রাপথে জলের সাথে ভূগর্ভস্থ অনেক খনিজও মিশতে থাকে। তারপরে সেই জল উপরের দিকে উঠতে থাকে এবং হট স্প্রিং শহরের কাছাকাছি পাথরের ফাটল দিয়ে বের হয়ে আসে। তখন এর তাপমাত্রা অবশ্য এত বেশি থাকে না, মোটামুটি ৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি থাকে। আমরা যেহেতু গ্রীষ্মকালে গিয়েছিলাম, সেই তাপমাত্রাই আমাদের কাছে অনেক বেশি মনে হয়েছিল। জল স্পর্শ করা যাচ্ছিল না এমন একটা অবস্থা হয়েছিল!
হট স্প্রিং ন্যাশনাল পার্কটা আমেরিকার অন্যান্য ন্যাশনাল পার্কের তুলনায় আয়তনে খুব ছোট। পার্কের ভেতরে ছোট জলাধার বা পুল রয়েছে যেখানে উষ্ণ ঝর্ণার জল এসে জমা হয়। আর পার্কের পাশেই বিভিন্ন স্থানে এই উষ্ণ জল বিশেষ ধরনের পাইপের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়, যেন মানুষ তা সংগ্রহ করতে পারে। যাবার আগে উইকিট্র্যাভেলে যখন ঝর্ণার ব্যাপারে পড়ছিলাম, তখন সেখানে লেখা ছিল যে হট স্প্রিং এ গেলে অবশ্যই এই ঝর্ণার জল সংগ্রহ করতে কারণ এতে ঔষধি গুণ রয়েছে এবং পানীয় জলের মতই সেটাও নিরাপদে পানযোগ্য। স্থানসংকুলান না হওয়ায় আমরা একটা বড় বোতল নিয়ে গেছিলাম কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখলাম যে মানুষ চার, পাঁচ গ্যালন পর্যন্ত জল সেখানে থেকে ভরে নিয়ে যাচ্ছে! এই যে উষ্ণ ঝর্ণার ঔষধি গুণ সেটা মানুষ অনেক আগে থেকেই জানত। হাজার বছর ধরে স্থানীয় মানুষজন এই পাহাড়গুলোর আশেপাশে বাস করত যারা নেটিভ আমেরিকান নামে বেশি পরিচিত। তারা নানান রকমের রোগব্যাধি সারাতে এই ঝর্ণার জল ব্যবহার করত। তারপর কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর ধীরে ধীরে ইউরোপিয়ান সেটেলাররা আমেরিকাতে আসতে শুরু করে। আরকানসাসে এসে উষ্ণ ঝর্ণার তাৎপর্য যখন তারা বুঝতে পারে তখন এই পাহাড়ঘেরা জায়গার চেহারা খুব দ্রুত বদলাতে শুরু করে।
![ছোট্ট পুলে জমা হওয়া উষ্ণ ঝর্ণার জল, তাপমাত্রা ৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াস](https://banglavibe.com/wp-content/uploads/2020/12/IMG_20190629_171622-1024x768.jpg)
হট স্প্রিং শহরটা একটা ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয় আর সেটা শুধুমাত্র এই উষ্ণ ঝর্ণাকে ঘিরেই। ঝর্ণার জলের গুণাগুণের কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। দূরদূরান্ত থেকে মানুষ চিকিৎসার জন্য সেখানে আসতে থাকে। আমেরিকা তো বটেই, জাহাজে সাগর পাড়ি দিয়ে সুদূর ইউরোপ থেকেও অনেকে আসত। আর্থ্রাইটিস এবং প্যারালাইসিসে আক্রান্ত রোগীরা সবচেয়ে বেশি আসত, কারণ এগুলো সহজে সারবার ছিল না, জীবনের শেষদিন পর্যন্ত মানুষকে ভুগতে হত।
চিকিৎসা সকলের জন্য মোটামুটি একই ছিল আর সেটা হচ্ছে নির্দিষ্ট সময় ধরে শরীরকে এই উষ্ণ জলের সংস্পর্শে রাখা। সেই উদ্দেশ্যে সেখানে অনেকগুলো স্নানাগার বা বাথহাউস গড়ে ওঠে। শহরের একটা অংশে সারি দিয়ে এইসব বাথহাউসগুলো ছিল, সেগুলোতে ভিন্ন ভিন্ন কক্ষে রোগীদের স্নানের ব্যাবস্থা করা হত। এই চিকিৎসা কখনো সাতদিন, আবার কখনো একমাস স্থায়ী হত। ফলে চিকিৎসা নিতে এসে রোগীদের দীর্ঘসময় এই শহরে অবস্থান করতে হত। এই বিশাল সম্ভাবনাময় মেডিকেল ট্যুরিজমের জন্য হট স্প্রিং শহরে তখন খুব দ্রুত ভালো রাস্তাঘাট, রেললাইন তৈরি হতে শুরু করে; হোটেল, রেস্তোরা, ক্লাব গড়ে ওঠে। দীর্ঘ সময় এমন রমরমা ব্যবসা চলার পরে উষ্ণ ঝর্ণা এবং সেটার আশেপাশের অঞ্চল সরকারের তত্ত্বাবধানে চলে আসে। আরো পরে সেটা ন্যাশনাল পার্কে পরিণত হয়।
আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কারের সাথে সাথে উষ্ণ ঝর্ণার রোগ উপশম ক্ষমতার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমতে থাকে। অনেক বাথহাউসের ব্যবসা পুরোপুরি উঠে যায়। হট স্প্রিং শহরে এইসব ঐতিহ্যবাহী বাথহাউসের কিছু এখনো আছে এবং মানুষ এখনো সেখানে স্নান করতে আসে; তবে চিকিৎসার জন্য নয়, শুধুই শৌখিনতার জন্য।
(তথ্যসূত্র: হট স্প্রিং ন্যাশনাল পার্ক ভিজিটর সেন্টার থেকে সংগ্রহ করা পত্রিকা)
![বর্তমানের অভিজাত বাথহাউস](https://banglavibe.com/wp-content/uploads/2020/12/20190629_152604-EFFECTS-1024x576.jpg)
![হট স্প্রিং শহরের ডাউনটাউন](https://banglavibe.com/wp-content/uploads/2020/12/20190629_181419-1024x576.jpg)