খেলাফতের ইতিহাস : শুরু থেকে শেষ (প্রথম পর্ব)

ইসলামভিত্তিক শাসনব্যবস্থাকে বলা হয় খেলাফত। এটি সরকারের ইসলামি রূপ যা মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক সংহতির প্রতিনিধিত্ব করে। খলিফা এ ব্যবস্থার সর্বোচ্চ প্রধান হিসেবে সরকারপ্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুর পর চালু হওয়া এই শাসনব্যবস্থা নিরবচ্ছিন্নভাবে পৃথিবীকে শাসন করেছে দীর্ঘ ১২৯২ বছর। তবে মোঙ্গল আক্রমণের কারণে মুসলিম বিশ্ব খেলাফতবিহীন ছিলো তিন বছর (১২৫৮-১২৬১)। এছাড়া ৯৩৬ সাল থেকে ১০৪৫ সাল পর্যন্ত ১১০ বছর এবং ১২৬১ সাল থেকে ১৫১৭ সাল পর্যন্ত ২৫৬ বছর, মোট এই ৩৬৬ বছর রাজনৈতিক দিক থেকে খেলাফত ছিলো অনেকটা দূর্বল। এর বাহিরে বাকি সময়টাতে খেলাফতের শৌর্য-বীর্য ছিলো আকাশচুম্বী। ইউরোপ, আফ্রিকা, এশিয়ার অধিকাংশ ভূমি ছিলো খেলাফতের আওতাধীন।

history-of-the-islamic-caliphate

পৃথিবীর অন্যতম পরাশক্তি এ খেলাফতের দাপটে ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতো পুরো পৃথিবীর রাজা-বাদশাহগণ। যেসব দেশে খেলাফতের শাসন চালু ছিলো না, তাদের মধ্যে অনেক দেশও খলিফাকে প্রতিকী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে স্বীকৃতি দিতো। তবে এই ১২৯২ বছরের দীর্ঘ সময়ে খেলাফত এক পরিবার বা বংশের মধ্যে ঠিকে থাকেনি। বিভিন্ন বংশের মধ্যে খেলাফতের ক্ষমতার পালাবদল ঘটেছে বিভিন্ন সময়ে। সর্বশেষ ১৯২৪ সালে খেলাফতের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটে।

খোলাফায়ে রাশেদীন (৬৩২-৬৬১)

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর মৃত্যুর পর মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা নির্বাচন নিয়ে প্রথম বিতর্ক বাঁধে। আলাপ-আলোচনার এক পর্যায়ে হযরত আবু বকর (রা.) প্রথম খলিফা নির্বাচিত হন। এটিই ছিলো মুসলিমদের প্রথম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। তার পরে খলিফা হন হযরত ওমর (রা.)। কিন্তু মাত্র ১০ বছর শাসনক্ষমতা পরিচালনা করার মাথায় তিনি ঘাতকের হাতে প্রাণ দিলে হযরত ওসমান (রা.) পান খেলাফতের দায়িত্ব। তার সময়ে পুরো সাম্রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহের দাবানল। অশান্তির এক পর্যায়ে একদল আততায়ীর হাতে তার জীবন শেষ হয়।

চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.)ও পারেননি পুরো সাম্রাজ্যকে ঐক্যের ছায়াতলে নিয়ে আসতে। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কণ্ঠ উচ্চকিত করেন দামেস্কের গভর্নর মুয়াবিয়া (রা.)। নিজেদের মধ্যে ঘটে যায় অনাকাঙ্ক্ষিত কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। নাহরাইনের যুদ্ধের পর বেশ কিছু উপদল আলী (রা.) এবং মুয়াবিয়া (রা.) উভয়ের বিরোধিতা শুরু করে। একপর্যায়ে তারা আলী (রা.) কে হত্যা করেন। অন্যদিকে মুয়াবিয়া (রা.) কে হত্যাচেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। তারপর খেলাফতের মনোনয়ন পান হযরত হাসান (রা.)। কিন্তু তিনি বিদ্রোহ দমন করতে না পেরে সন্ধি করে মুয়াবিয়া (রা.) এর হাতে খেলাফতের দায়িত্ব ছেড়ে দেন। এর মাধ্যমেই সমাপ্তি ঘটে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বিতর্কমুক্ত খেলাফতের।

মাত্র ৩০ বছরের শাসনকালে খোলাফায়ে রাশেদীনরা কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন তৎকালীন দুই পরাশক্তি বাইজেন্টাইন ও পারস্য সাম্রাজ্যের ভিত। মুসলিম সাম্রাজ্যের সীমানা এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন অনেক দূরে। ৬৫৪ খ্রিস্টাব্দে খলিফাদের শাসনের আওতায় ছিলো প্রায় ৩.৬ মিলিয়ন বর্গমাইল এলাকা। ওসমান (রা.) এর সময় পর্যন্ত খেলাফতের রাজধানী মদীনায় থাকলেও আলী (রা.) তা স্থানান্তর করেন কুফায়।

উমাইয়া খেলাফত (৬৬১-৭৫০)

ইসলামের দ্বিতীয় এই খেলাফতটি আবর্তিত হয় আরবের উমাইয়া বংশকে কেন্দ্র করে। উমাইয়া খেলাফতের সূচনা করেন মুয়াবিয়া (রা.)। তার মৃত্যুর আগেই খেলাফতের উত্তরাধীকারী নির্বাচন করে যান পুত্র ইয়াজীদকে। এভাবেই খেলাফত ব্যবস্থায় রাজতন্ত্রের সূচনা হয়। আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) এবং হোসাইন (রা.) এর মতো প্রখ্যাত অনেক সাহাবী তার বিরোধিতা করেন। উমাইয়া খেলাফতের এক পর্যায়ে পুরো সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে আব্বাসীয় আন্দোলনের দাবানল। শক্তিশালী উমাইয়া খেলাফতের পতন ঘটে আব্বাসীয় পরিবার কর্তৃক পরিচালিত হাশিমিয়া আন্দোলনে।

৭৫০ সালে এক যুদ্ধে আব্বাসীয়দের হাতে সর্বশেষ উমাইয়া খলিফা দ্বিতীয় মারওয়ানের পরাজয় ও মৃত্যু ঘটে। এর মাধ্যমেই উমাইয়াদের ৯০ বছরের শাসনকালের সমাপ্তি ঘটে। প্রথমে তাদের রাজধানী দামেস্কে থাকলেও ৭৪৪ সালে হারানে স্থানান্তরিত করা হয়।

উমাইয়ারা মুসলিমদের বিজয় অভিযান অব্যাহত রাখেন। ৭১২ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাশিম ইন্দুজ নদীসহ সিন্ধু ও পাঞ্জাব অঞ্চল জয় করেন। অন্যদিকে পশ্চিমে স্পেন ও ফ্রান্স অভিমূখে অগ্রসর হন আরেক সেনাপতি তারেক বিন যিয়াদ। সাম্রাজ্যের সীমানা ছড়িয়ে পড়ে ককেশাস, ট্রান্সঅক্সানিয়া, সিন্ধু, মাগরেব ও ইবোরিয়ান উপদ্বীপ (আন্দালুস) পর্যন্ত। উমাইয়া খেলাফতের শেষ সময় পর্যন্ত ৫.৭৯ বিলিয়ন বর্গমাইল (১৫০০০০০০ বর্গ কি.মি.) এর মতো বিশাল এলাকা তাদের দখলে ছিলো।

উমাইয়াদের ছিলো উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রহ.) এর মতে দক্ষ শাসক, যিনি ধর্মপরায়ণতা ও অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। উমাইয়ারা ৯০ বছরে সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক, সামরিক এবং অর্থনৈতিক ব্যাপক উন্নতি সাধন করেন। ধারাবাহিক বিজয়ের মাধ্যমে অর্থনীতির ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। ফলে অবিশ্বাস্য রকম ধনী এবং একটি স্থিতিশীল সাম্রাজ্যে পরিণত হয় মুসলিম খেলাফত।

২য় পর্বে আমরা আলোচনা করবো আব্বাসীয় খেলাফত (৭৫০-১২৫৮), মামলুকদের অধীনে আব্বাসীয় খেলাফত (১২৬১-১৫১৭) নিয়ে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

Similar Posts