শহরে কেন দেখি না তারা
আচ্ছা, কখনো কি প্রশ্ন জেগেছে এমন, যে আমরা যে শহরে থাকি, সেখান থেকে এত অল্প তারা দেখা যায় কেন? খুব করে দেখলে হয়তো ছিটে-ফোঁটা একটু-আধটু দেখা যায়। কিন্তু আবার গ্রামে গেলে রাতের আকাশ পানে তাকালে বেশ কিছু তারা চোখে পড়ে যায়। এমন কেন হয়?
আজ থেকে একশো বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা রাত বলতে যা বুঝত, এখন আর তেমন নেই। রাত বলতে তাঁরা যে নিকষ কালো অন্ধকারকে চিনত, আমরা সে অন্ধকার থেকে যথেষ্ট সরে এসেছি। আমাদের রাতও এখন আলোকিত। শ’য়ে শ’য়ে জ্বলতে থাকা সড়কবাতি, দোকানপাট-ভবন এর আলো যেন ছেদ ঘটিয়েছে রাতের অন্ধকারকে।
কিন্তু তাতে অসুবিধে কোথায়, অন্ধকারকে জয় করা তো মানুষের অন্যতম একটা মাইলফলক ছিল, তাই না? তবে আসলে ব্যাপারটা ঠিক এরকম নয়।
আমাদের শহরগুলো রাতের বেলায় এখন আলোকিত। কৃত্রিম আলোয় যেন জেগে থাকে পুরো শহর। কিন্তু এসব আলোরও একটা অন্ধকার দিক রয়েছে। বেশি কৃত্রিম আলোর ব্যবহারে বেড়ে যাচ্ছে আলোকদূষণ। যদিও পানি, বায়ু ও শব্দদূষণ নিয়ে আমরা যতটা না চিন্তিত, আলোকদূষণের প্রভাব কম বলে আমরা এটি নিয়ে তেমন চিন্তিত নই। কিন্তু এটিরও প্রভাব আছে আমাদের উপর। মিটমিটিয়ে জ্বলতে থাকা তারাসহ অন্যান্য মহাকাশীয় বস্তু দেখতে না পারা ছাড়াও মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর উপর বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব আছে আলোকদূষণের।
আমাদের ঘুমের জন্য অন্ধকার বেশ উপকারী। ঘুমের সময়ে মেলাটোনিন হরমোনের মাত্রা বাড়তে থাকে, সাধারণত মধ্যরাতে এর মাত্রা হয় সর্বাধিক। এ হরমোনটি যেমন আমাদের ঘুমে সহায়ক, তেমনি ইমিউনিটি বুস্ট করতে কিংবা অঙ্গসমূহের কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। আমাদের ঘুম আর জাগরণের ছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করে এ হরমোন। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত আলোকদূষণের জন্য এ হরমোন স্খলনের মাত্রা কমে যায়। ঘুমের সময়ে আলোর উপস্থিতি থাকলে এ হরমোন নিঃসরণ ব্যাহত হয় আর ঘুমের অসুবিধা ঘটে।
এছাড়া মাথাব্যথা, চর্মরোগ, শারীরিক ক্লান্তি, মানসিক অবসাদ বা ওজন বেড়ে যাওয়ার মত সমস্যাও তৈরি হয় এ হরমোনের নিঃসরণ ঠিকঠাক না হলে।
শুধু মানুষই নয়, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে জীবকূলও
আলোকদূষণ এর ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিশাচর প্রাণীরা। অতিরিক্ত আলোর জন্য দিন-রাতের পার্থক্য করতে অসুবিধায় পড়ছে তারা। যেসব পরিযায়ী পাখি রাতে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাত্রা করে, অতিরিক্ত আলোর জন্য তাদের চলাচল ব্যাহত হচ্ছে মারাত্মকভাবে। জোনাকি পোকারও বংশবৃদ্ধির জন্য অন্ধকার বিশেষ প্রয়োজন। পুরুষ জোনাকি উদরের নিচের আলো দিয়ে স্ত্রী জোনাকিকে আকর্ষণ করে। কৃত্রিম আলো বেড়ে যাওয়ায় এ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াটা বিঘ্ন ঘটছে। উদ্ভিদের অন্ধকার চক্রও সম্পন্ন হতে সমস্যা হচ্ছে। যেসব পরাগায়ন রাতে সংঘটিত হত, ব্যাহত হচ্ছে সেগুলোও।
আর আমাদের চোখের উপরও একটা প্রভাব হচ্ছে। সাধারণত আমরা দিনে যখন দেখি, সে দৃষ্টিকে বলা হয় ‘ফটোপিক ভিশন’। উজ্জ্বল লাল, নীল ও সবুজ রঙগুলোর জন্য এ দৃষ্টি তৈরি হয়। আর রাতে আমরা দেখি ‘স্কোটোপিক ভিশন’, যেটা মূলত তৈরি হয় উজ্জ্বল আলোর অনুপস্থিতিতে চোখের রড কোষগুলোর জন্য। কিন্তু আলোকদূষণের জন্য আমাদের চোখের রড কোষের কার্যকারিতা কমে যাচ্ছে। অর্থাৎ অন্ধকারে বা আবছা আলোতে দেখার যে আমাদের একটা প্রাচীন ক্ষমতা ছিল, সেটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।
আলোকদূষণ এর ফলে আকাশে একটা পরিবর্তন এসেছে। আমাদের শহরের আকাশের একটা বিচিত্র ব্যাপার হল, রাত্রিবেলায় আকাশটা কেমন যেন উজ্জ্বল দেখা যায়। অর্থাৎ আকাশ কেমন যেন আলো ছড়াচ্ছে বলে মনে হয়। অথচ সূর্য ডুবে যাওয়ার পর, এমন কোনো ঘটনা ঘটার কথা ছিল না। তাহলে ব্যাপারটা কী?
আমরা যে কৃত্রিম আলো ব্যবহার করি, এ আলোর ফোটন কণাগুলো ছড়িয়ে পড়ে উপরের দিকে। যতই এ কণাগুলো বৃদ্ধি পায়, আমাদের উপরে এগুলো ঘনীভূত হয়ে আলোকদীপ্তির সৃষ্টি করে। ফলে আমরা যখন উপরে তাকাই, আকাশটাকে জ্বলজ্বল করতে দেখি। এর জন্যেই মূলত আমাদের আকাশ থেকে তারাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
আকাশের এই আলোকদীপ্তির কারণে পৃথিবীর প্রায় আশি শতাংশ মানুষ ৯৯.৫% নক্ষত্র, যেগুলো খালি চোখে দেখতে পাওয়ার কথা, দেখতে পায় না। এটা দুঃখজনক যে, এই পৃথিবীতে বাস করেও আমরা আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি খালি চোখে দেখতে পারছি না।
তবে ১৯৯৪ সালে লস এঞ্জেলাস শহরে ঘটে একটা মজার ঘটনা। সে বছর ১৭ জানুয়ারি ভূমিকম্প হয়ে পুরো শহরের বিদ্যুৎ চলে যায়। ফলে নিভে যায় সব আলো, অন্ধকারে তলিয়ে যায় সব কিছু। এমন সময়ে শহরের মানুষেরা ভোরের আগ দিয়ে হঠাৎ আকাশে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যায়। কয়েকজন তো জরুরি বিভাগে ফোন করাও শুরু করে। তারা নাকি আকাশে ভয়ানক একটা সাদা মেঘের মত কিছু দেখতে পেয়েছে।
মূলত তারা সেদিন মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি দেখতে পেয়েছিল। সে সাথে দেখতে পেয়েছিল অসংখ্য তারা। বিদ্যুৎ চলে গিয়ে আলোকদূষণের মাত্রা একেবারে কমে যাওয়ায় খালি চোখেই দেখা গিয়েছিল এসব।
আমরা খালি চোখে ঠিক কতটুকু নক্ষত্রমালা দেখতে পাব, তা নির্ভর করে আলোকদূষণের মাত্রার উপর। এটা হিসেব করার বিভিন্ন স্কেল রয়েছে তার মধ্যে বোর্টল ডার্ক-স্কাই স্কেল বেশ জনপ্রিয়। এর ১ থেকে ৯ টি ক্লাস রয়েছে। আলোর উপস্থিতি একেবারেই কম হলে ১ আর সর্বাধিক হলে ৯।
২০১৫ সালে করা পরিমাপ থেকে আমাদের রাজধানী ঢাকার আলোকদূষণের মাত্রা স্থানভেদে চার থেকে সাত। প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিনে এ মাত্রা আবার এক! অর্থাৎ সেন্ট মার্টিন থেকে চমৎকারভাবে নক্ষত্রমালা দেখতে পাওয়ার কথা!
শুরুতে একটা প্রশ্ন করেছিলাম, যে গ্রামে গেলে বেশি তারা কেন দেখতে পাওয়া যায়। এর কারণটা এখন নিশ্চয়ই স্পষ্ট? গ্রামে আলোকদূষণ এর মাত্রা শহর থেকে কম বলে আকাশ যথেষ্ট পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়।
আলোকদূষণ হয়তো পুরোপুরি কমানো সম্ভব না। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় কৃত্রিম আলো হ্রাস করে, হয়তো এর মাত্রা কমানো যেতে পারে। আর শুধুমাত্র আলোকদূষণ এর মাত্রা কমানো গেলেই, হয়তো আমরা প্রাণভরে জ্বলজ্বল করতে থাকা নক্ষত্রের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারব।
তথ্যসূত্রঃ
২. https://www.britannica.com/science/light-pollution#ref1084470
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের আলোকদূষণের বোর্টল স্কেল এর মাত্রা দেখুন এ লিংক থেকেঃ https://www.lightpollutionmap.info/