ডিমেনশিয়া এবং টাইম লুপ

বাসা থেকে বের হওয়ার সময় কিছু একটা নিয়ে হয়ত মনটা প্রচন্ড খুঁতখুঁত করছে। কিন্তু বুঝতে পারছেন না সেই কিছুটা কি। হয়ত কিছু ফেলে যাচ্ছেন কিংবা কাউকে ফোন দিতে হবে। কিন্তু তাড়াহুড়োর কারণে পরে মনে পড়লে তখন দেখা যাবে ভেবে বাসা থেকে বের হয়ে পড়লেন। এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তিতে স্বভাবতই আপনি ডিমেনশিয়া নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান!

ডিমেনশিয়া এবং টাইম লুপ

বাসা থেকে বেরনোর ঘন্টাখানেক পর আপনার এক বন্ধুর সাথে ফোনে কথা হলে আপনি জানতে পারলেন, আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ কাগজ নিয়ে সেই বন্ধুর সাথে আপনার দেখা করার কথা ছিলো। আপনার-ই তাকে ফোন দিয়ে একটি নির্দিষ্ট স্থানে আসতে বলার কথা ছিলো। অবশেষে আপনি মনে করতে পারলেন বটে, কিন্তু দুই দিন আগে হওয়া সিদ্ধান্তের কথা কি করে ভুলে গেলেন তা ভেবে আফসোস করতে লাগলেন। আপনার নিত্য দিনকার ঘুম থেকে উঠে সকালের নাস্তা করা, ফরমাল পোষাক পড়ে অফিসের বাস ধরা, অফিস শেষ করে বাসায় পৌছা, তারপর রাতের খাবার শেষে ঘুমোতে যাওয়া ইত্যাদি সব কিছু দিব্যি করে যাচ্ছেন। তার মানে কি এই যে, আপনার সব কিছু মনে আছে ঠিকই কিন্তু আপনি আটকে গেছেন একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেড়াজালে!

চলুন, ডিমেনশিয়া এবং টাইম লুপ-এর ব্যাপারটা একটু বিশ্লেষণ করে দেখা যাক।

ডিমেনশিয়া

ডিমেনশিয়ার ব্যাপারে আপনারা সবাই জানেন যে, এটা হলো কোন কিছু ভুলে যাওয়ার প্রবণতা। এটা কোন রোগ নয় কিন্তু আলজেইমার রোগের কারণে এ অবস্থার তৈরী হয়। চূড়ান্তভাবে ডিমেনশিয়া গ্রস্ত ব্যক্তি স্থায়ী ভাবে পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।

মস্তিষ্কের কোষগুলো নিজেদের মধ্যে সঠিক ভাবে যোগাযোগ করতে না পারার দরুণ নির্দিষ্ট কোন কিছুর প্রতি মনোনিবেশে জটিলতা সৃষ্টি হয়। ফলে ব্যক্তি কোন সময় বা স্থানে অবস্থান করছে সেদিকে খেয়াল রাখতে পারেন না। যে কোন হিসেব-নিকেষে ভুল করে ফেলেন।

ডিমেনশিয়া থেকে মুক্তির জন্য ডাক্তাররা সুষম খাদ্য ও ব্যায়ামের পাশাপাশি যে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করতে বলেন তা হচ্ছে- নতুন কিছু শেখা, সুডোকু মেলানো, আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবদের সাথে আড্ডা দেয়া। সর্বসাকুল্যে মস্তিষ্ককে সর্বদা নতুন নতুন কাজে ব্যস্ত রাখা।

টাইম লুপ

খুব সহজভাবে বলতে গেলে একটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পুনরাবৃত্তিকে টাইম লুপ বা সময়ের অন্তর্জাল বলা হয়। এখন পর্যন্ত এটা শুধুই একটা ধারণা মাত্র, এর কোন ব্যবহারিক প্রমাণ নেই। যদিও বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর ভেতর দিয়ে বিভিন্ন ভাবে টাইম লুপকে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।

ধরুন, আপনি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর সময়টুকু পাড়ি দিয়ে আবার এই বছরের জানুয়ারি মাসে ফিরে আসতে চান। সেক্ষেত্রে বুঝতেই পারছেন; ডিসেম্বরের ৩১ তারিখের পর একই সালের জানুয়ারির ১ তারিখে যাওয়ার জন্য আপনার অতীতে ফিরতে হবে। আর এখানেই চলে আসে টাইম ট্র্যাভেল ব্যাপারটা। তার সাথে সাথে ২০২১ সালে আপনার জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও সম্পৃক্ত। কারণ মানুষের জীবনের প্রতিটি ঘটনা একটা আরেকটার উপর নির্ভরশীল।

শুধু তাই নয়, সময়ের রেখাটা শুধু আপনার জন্য আবার নতুন করে শুরু হবে না। আপনি যখন জানুয়ারির ১ তারিখে ফিরবেন তখন সে সময়ের মানুষগুলোর কাছে আপনি হবেন ভবিষ্যতের মানুষ। শুধু একবার ভাবুন তো, আপনার জন্মদিনের পার্টিতে আপনার অতীতের ভার্সনটা আপনার ভবিষ্যতের ভার্সনটাকে দেখে কীরকম ভীড়মি খাবে! যদিও এটা সম্ভব নয়। আর এই অসম্ভবপর বিষয়টিকেই বলা হয় প্যারাডক্স।

ডিমেনশিয়া নাকি টাইম লুপ

আপনার পরিচিত কেউ ডিমেনশিয়ায় ভুগছেন কিনা তা নিশ্চিত হতে তার স্মৃতিশক্তি যাচাই করুন। ডিমেনশিয়াগ্রস্ত ব্যক্তিরা সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো থেকে দূরবর্তী ঘটনাগুলোকে স্মৃতিতে ধারণ করতে পারে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো তাদের স্মৃতি থেকে মুছে যায়।

ধরুন, কেউ শুক্রবারে ঘুম থেকে উঠে রবি থেকে বৃহস্পতিবারের মত কর্মদিবস পালন করছেন। এমনকি, তিনি দাবিও করছেন যে আজ রবিবার। তাহলে শুধু তার ক্ষেত্রেই ২৪ ঘন্টা কর্মদিবসকে কেন্দ্র করে টাইম লুপ ঘুরছে। কারণ হয়ত তিনি পূর্বে একটা দীর্ঘ সময় ধরে কোন অফিসে কাজ করেছেন। তাছাড়া ছুটির দিক থেকে কর্মদিবস বেশী বিধায় সে সময়গুলোতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তার মনে গেঁথে আছে।

এখানে তাদের টাইম লুপটা পূর্ণ করতে কোন টাইম ট্র্যাভেল করার প্রয়োজন হচ্ছে না। ডিমেনশিয়া মস্তিষ্কের এমন অবস্থা করে রেখেছে যে, ঘুম থেকে উঠার পর তারা সকাল ৭টাকে দ্বিতীয় দিনের কোন সময় ভাবতে পারছে না।

যারা গ্রাউন্ডহগ ডে অথবা ফিফটি ফার্স্ট ডেট মুভি দুটি দেখেছেন তারা ইতোমধ্যেই ব্যাপারটার অভিজ্ঞতা পেয়ে গেছেন।

গ্রাউন্ডহগ ডে-এর মুল চরিত্র দাবি করেছিলো যে, সে প্রতিবার একই দিনের সম্মুখীন হচ্ছে। দিনটির প্রতিটি ঘটনা তার সাথে এর আগেও ঘটেছে। এ বিষয়টির নাম ডেজা ভ্যু।

আর ফিফটি ফার্স্ট ডেট-এর মুল চরিত্র জানতো না যে, সে প্রতিটা দিনকে তার বাবার জন্মদিন ভেবে কাটাচ্ছে। সে প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে নতুনভাবে সবার সাথে পরিচিত হতো।

টাইম লুপ পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র মেনে না চললেও মনস্তাত্ত্বিক বিষয় ডিমেনশিয়ার দৌলতে সগরিমায় নিজের জায়গা করে নিয়েছে। কেই বা বলতে পারে, হয়ত অতি নিকট ভবিষ্যতে টাইম লুপের ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্ভব হয়ে যাবে। আপনি ডিমেনশিয়া নিয়ে ভয় না করেও হয়ত টাইম লুপ কাজে লাগিয়ে আপনার জীবনের ভুলগুলো আক্ষরিক অর্থেই শুধরে নিতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে আপনার সাথে যদি আপনার পুরোনো ভার্সনের দেখা হয়ে যায়, তাহলে কী নতুন কোন সময়রেখা তৈরী হবে নাকি অন্য কোন ভাবে সময় নিজের গতি অবিকৃত রাখবে? এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানাতে পারেন।

Similar Posts