রহস্যময় গ্রাম জাতিঙ্গা: যেখানে পাখিরা আত্মহত্যা করে!

আত্মহত্যার প্রবণতা সারা বিশ্বের মানুষের মাঝেই কমবেশি দেখা যায়। কিন্তু পাখিরা কি আত্মহত্যা করতে পারে? ভাবতেই কেমন হাস্যকর লাগে। আসলে এধরনের কাজের জন্য যতটা চিন্তাশক্তি দরকার তা তো পাখিদের নেই। তাহলে এদের মধ্যে আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগবে কিভাবে? কিন্তু এমন ঘটনাই প্রায় প্রতিবছর ঘটে যাচ্ছে ভারতের জাতিঙ্গা গ্রামে। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস কোনো অশুভ শক্তি পাখিদের এইভাবে টেনে নিয়ে আসে, তারপর মেরে ফেলে। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন অন্যকথা। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই ঘটনার ইতিহাস।

mysterious-village-jatinga-where-birds-commit-suicide

“সুইসাইড জোন” জাতিঙ্গা

ভারতের আসাম রাজ্যের উত্তর কাছার জেলার হাফলং থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার দূরে প্রাকৃতিক সৌ্ন্দর্যে পরিপূর্ণ একটি গ্রাম জাতিঙ্গা। এই গ্রামকে ঘিরে রয়েছে বেশ কিছু সুউচ্চ পাহাড়। তবে এই মনোরম প্রাকৃ্তিক দৃশ্যই এই গ্রামের একমাত্র পরিচিতি নয়, বরং মানুষের কাছে এই গ্রাম এত পরিচিত পাখিদের রহস্যময় মৃত্যুর কারণেই ।

প্রায় প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে এবং নির্দিষ্ট পরিবেশে জাতিঙ্গা গ্রামের পাখি মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে। বিশেষ করে বর্ষার শেষের দিকে জাতিঙ্গা গ্রামের অধিবাসীরা পাখিদের এই আসার জন্য অপেক্ষা করে। সম্পূর্ণ নিকষ কালো আঁধার অমাবস্যার রাত, মেঘলা আকাশ, সাথে বৃষ্টি হওয়ার পরের স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া এই ঘটনার জন্য একদম উপযুক্ত। এমন রাতে গ্রামবাসীরা ঘরের বাইরে উজ্জ্বল আলো জ্বেলে রাখে। কেউ আবার খোলা জায়গায় আগুন পোহাতে বসে। এমনই বিশেষ এক রাতে পাখিরা ঝাঁকেঝাঁকে এই গ্রামের দিকে উড়ে আসে। যেখানেই কোনো আলোর উৎস থাকে সেখানেই আলোর দিকে এরা ঝাঁপিয়ে পড়ে।

এভাবে কিছু পাখি আগুনে ঝলসে মরে, কিছু মরে গাছের ডালপালা বা শক্ত কিছুর আঘাতে। যেন স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করতেই এসেছে তারা! আর কিছু পাখিকে মানুষই আঘাত করে মেরে ফেলে, কারন তাদের বিশ্বাস এসব পাখি অশুভ শক্তির দ্বারা পরিচালিত। তাই অশুভ শক্তি থেকে মুক্তি পেতেই তারা পাখিগুলোকে মেরে ফেলে। তারপর এসব পাখির মাংস দিয়ে হয় ভোজ উৎসব।

অনেকে আবার মনে করেন প্রায় হাজার বছর আগের কোনো প্রাচীন অভিশাপের কারনে পাখিগুলো এভাবে মারা পরে। এরকম নানারকম মত প্রচলিত আছে। আগে শোনা যেত একেকজন মানুষ ১০০-২০০টি পর্যন্ত পাখি আঘাত করে মেরে ফেলত। তবে এখন প্রকৃ্তিতে এসব পাখির পরিমান অনেক কমে গেছে। তাই আগের মতো এখন আর এতো পাখি আসে না।

ইতিহাস

ঘটনাটি প্রথম ঘটে ১৯০৫ সালে। শোনা যায়, একরাতে এই গ্রামে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়। তখন গ্রামের আদিবাসীরা লক্ষ্য করেন তাদের পালিত একটি মেষ হারিয়ে গেছে। সেসময় পালিত পশুগুলো তাদের জীবনধারনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই এই দুর্যোগপূর্ণ রাতেও মশাল জ্বালিয়ে তারা পালিত পশুটিকে খুঁজতে গেল।

সেদিন ছিল সম্পূর্ণ অন্ধকার রাত। মশালের আলো ছাড়া আশেপাশে আর কোনো আলো নেই। তারপর আবার ঝড় বাদল লেগেই আছে। এমন অবস্থায় তারা পশুটিকে খুঁজে চলেছে। হঠাৎ তাদের খেয়াল হলো ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি তাদের দিকে উড়ে আসছে। এরপর তাদের মশালকে লক্ষ্য করে পাখিগুলো ঝাপিয়ে পড়তে লাগলো। মশালের আগুনে অনেক পাখির দেহ ওখানেই ঝলসে গেল আর অনেক পাখি আশেপাশের গাছপালার ওপর আছড়ে পড়ে মারা গেল। যেগুলো মরলো না সেগুলো দিগভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক ওড়াউড়ি করে একসময় ক্লান্ত হয়ে মারা গেল।

এ দৃশ্য দেখে মেষ সন্ধানে আসা দলটি ভয়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। পরেরদিন দেখা গেল পুরো গ্রামজুড়ে হাজার হাজার পাখি মরে পড়ে আছে। গ্রামের লোকেরা এটিকে কোনো অশুভ বার্তা মনে করলো। তারপর থেকে প্রায় প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট সময়ে (আগস্ট থেকে অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি যে কোনো সময়ে) এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে আসছে।

বিজ্ঞানীরা কি বলেন

জাতিঙ্গা গ্রামের পাখি মৃত্যুর এই ঘটনা বহুকাল বাইরের মানুষের কাছে অজানা ছিল। ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ চা ব্যবসায়ী ও পক্ষীবিশারদ ই পি জী তার বিখ্যাত গ্রন্থ The Wild Life of India তে জাতিঙ্গা গ্রামের এই পাখি মৃত্যুর ঘটনা বর্ণনা করেন। সেই সময় তার এই বইটি বাইরের মানুষের কাছে সাড়া ফেলে দেয়। তিনি তার বইতে এই ঘটনার বিশেষ কিছু লক্ষণ জানিয়েছিলেন। যেমন- এই দিন বাতাস বইতে হবে দক্ষিন থেকে উত্তরে। চাঁদহীন অন্ধকার আকাশ হতে হবে মেঘলা ও কুয়াশাচ্ছন্ন। পাখি আসার জায়গা হতে হবে বেশ খোলামেলা।

এসব পাখিরা বেশিরভাগ উজ্জ্বল ও গোলাকার আলোর দিকে বেশি আকৃষ্ট হয় এবং সন্ধ্যা সাতটা থেকে রাত দশটা পাখিগুলো আসার জন্য আদর্শ। প্রায় ৪৪ প্রজাতির পাখি এই মরণযাত্রায় অংশ নেয় এবং এদের বেশিরভাগই রাতের পাখি।

তার বই প্রকাশের পর অনেকে এই ঘটনার ব্যাখ্যা খোঁজার জন্যে এটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯৭৭ সালে পক্ষী বিশারদ ডঃ সুধীন সেনগুপ্তকে জুলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পক্ষ থেকে সেখানে পাঠানো হয়। তার মতে পাখিদের এই অদ্ভুত আচরণের মূলে রয়েছে আবহাওয়া ও বায়ুচাপের আকস্মিক পরিবর্তন ও বর্ষায় বেড়ে যাওয়া পানির স্তর। সাথে জাতিঙ্গা পাহারে থাকা উচ্চ চুম্বকশক্তি যুক্ত খনিজ পদার্থ ও ভূ অভ্যন্তরে থাকা ফাটল এর জন্য দায়ী হতে পারে। এসব কিছুর মিলিত প্রভাবে ওই স্থানের চৌম্বকশক্তি ও মাধ্যাকর্ষণ শক্তির পরিবর্তন হতে। ফলে পাখিদের স্নায়ুর ওপরে এসব ব্যাপক প্রভাব ফেলে। যার কারনেই পাখিরা এমন বিভ্রান্ত আচরণ করে বলে ধারণা করেন তিনি।

তবে আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে এত এত গবেষণার পরেও এসব তত্ত্বের কোনো সত্যতা নিশ্চিত করা যায় নি। অনেক প্রশ্নের কোনো উত্তরও খুঁজে পাওয়া যায় নি। যেমন, গবেষকরা এই মরণ যাত্রায় অংশ নেয়া অনেক পাখিকে কোনো রকম আঘাত পেতে না দিয়েই ধরে ফেলেন, এবং তাদের বাঁচানোর উদ্দেশ্যে অনেক যত্ন করেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো এই পাখিগুলোকে কোনো ভাবেই আর বাঁচানো যায় না। এদের খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করা হলেও আর খায় না। এবং এভাবেই একদিন অনাহারে মারা যায়। যেন এক চরম বিষণ্ণতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এরা, বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছেই যেন আর নেই! কেন পাখিগুলো এই অদ্ভুত আচরণ করে তা সত্যিই আজও এক রহস্য।

শেষ কথা

নিরীহ এই পাখিগুলোর মৃত্যুর মিছিল কি আসলেই এদের আত্মহত্যা, নাকি এর মাঝে রয়েছে অন্য কোনো কারণ? এর উত্তর এখনো অজানা। তবে স্থানীয় মানুষকে বুঝিয়ে এই পাখিগুলোকে আঘাত করে নির্মম ভাবে হত্যা করা থেকে অনেকটাই সরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। তবুও পাখিগুলোকে বাঁচানো সম্ভব হয় না।  প্রতিবছর অনেক মানুষ এই রহস্যময় ঘটনার সাক্ষী হতে ভারতের জাতিঙ্গা গ্রামে যান। ছোট্ট পাখিগুলোর নিথর দেহ মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে পর্যটকরাও হয়ে পড়েন বিষণ্ণ। পাখিদের এই অদ্ভুত মরণ যাত্রা আজও মানুষের কাছে এক রহস্যই রয়ে গেছে।

Similar Posts