মানুষের পরিচয় শনাক্তে হরেক রকম প্রযুক্তি- ২য় পর্ব

(গত পর্বের পরে…)

প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মানুষের বৈশিষ্ট্য নিখুঁতভাবে শনাক্ত করার যন্ত্রও আবিষ্কার করা হয় । এতে করে মানুষের শরীরবৃত্তীয় শনাক্তকারী বৈশিষ্ট্যগুলোকে বিশেষভাবে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয় ।

মানুষের পরিচয় শনাক্তে হরেক রকম প্রযুক্তি

বর্তমানে ব্যক্তির শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে বহুল ব্যবহৃত শরীরবৃত্তীয় পদ্ধতিটি হলো আঙ্গুলের ছাপ বা ফিঙ্গার প্রিন্ট যাচাই । গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সৃষ্টিগতভাবে পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের আঙ্গুলের ছাপ ভিন্ন ভিন্ন হয় । একজনের আঙ্গুলের ছাপ কখনোই অন্যজনের অনুরূপ হবে না, এক জনের টিপসই কখনোই অন্যজনের টিপসইয়ের সাথে মিলবে না । তাই মানুষের আঙ্গুলের ছাপকে ফিঙ্গার প্রিন্ট রিডারের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা হয় ।

ফিঙ্গার প্রিন্ট মেশিনটি আঙ্গুলের রেখার বিন্যাস, ত্বকের টিস্যু এবং ত্বকের নিচের রক্ত সঞ্চালনের উপর ভিত্তি করে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক পদ্ধতিতে আঙ্গুলের ছাপচিত্র তৈরি করে । তারপর ডাটাবেজের সাথে মিলিয়ে, মানুষকে শনাক্ত করা হয় । এই পদ্ধতিটি বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজ ব্যবহার করা হয় । কিন্তু, অসৎ লোকেরা তেল বা লুব্রিকেন্ট জাতীয় পদার্থ আঙ্গুলে লাগিয়ে হাতের ছাপকে অস্পষ্ট করে ফেলে । অনেকের ক্ষেত্রে হাতের বিশেষ রোগের কারণে আঙ্গুলের ছাপ অস্পষ্ট থাকতে পারে । বিশেষ গ্লাভস তৈরি করে অন্যজনের আঙ্গুলের ছাপ নকল করার নজিরও পাওয়া যায় ।

আঙ্গুলের ছাপ
আঙ্গুলের ছাপ শনাক্ত করে ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা যায়।

হাতের রেখা শনাক্তের মাধ্যমেও ব্যক্তির পরিচয় শনাক্তের পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে । হাতের পুরুত্ব, আকার, হাতের রেখার বিন্যাস, আঙ্গুলের দৈর্ঘ্য ইত্যাদি তথ্য বিশ্লেষণ করে এবং ডাটাবেজে সংরক্ষিত পূর্বের তথ্যের সাথে মিলিয়ে ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয় । তবে এ পদ্ধতি খুব একটা কার্যকর নয় । কায়িক শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ভালো ফলাফল দেয় না । হাতে কিছু লেগে থাকলেও সঠিক ফলাফল পাওয়া যায় না ।

সৃষ্টিগতভাবে মানুষের চোখের বিশেষ অঙ্গের গঠনও ভিন্ন ভিন্ন হয় । তাই বিশেষ স্ক্যানারের সাহায্যে চোখের মণির চার পাশে বেষ্টিত রঙিন বলয় বা আইরিশ বিশ্লেষণ করে শনাক্তকরণের কাজ সম্পন্ন করা হয় । এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ব্যক্তিকে শনাক্ত করার কাজে সময় অপেক্ষাকৃত কম লাগে এবং সূক্ষ্মতার গ্রহণযোগ্যতার মাত্রা বেশি হয় । তবে কন্টাক্ট লেন্স পরা থাকলে এই পদ্ধতি যথাযথ কাজ নাও করতে পারে ।

ফেইস রিকগনিশান বা মানুষের মুখমণ্ডল স্ক্যানের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত করা হয় । এই পদ্ধতিতে পুরো মুখমণ্ডলের ছবি তুলে তার বিভিন্ন অংশের জ্যামিতিক মাপ, রং এবং আকার ডাটাবেজে সংরক্ষণ করা হয় । পরবর্তীতে ব্যক্তির ছবির সাথে এই তথ্যগুলো মিলিয়ে পরিচয় শনাক্ত করা হয় । নানা কারণে ব্যক্তির মুখের বিভিন্ন অংশের জ্যামিতিক আকৃতি কিছুটা পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে । সূর্যের আলোর প্রভাবে ত্বকের রং কালো হয়ে যেতে পারে । তখন এই প্রযুক্তি সঠিক ফলাফল নাও দিতে পারে ।

ফেইস রিকগনিশান
ফেইস রিকগনিশান।

ডিএনএ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানুষকে একেবারে নিখুঁত, নির্ভুল ও প্রশ্নাতীতভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয় । মানবদেহের যেকোনো অংশ থেকে, যেমন- হাত, পা, রক্ত, চুল, মুখের লালা ইত্যাদি অংশ থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করা হয় । এরপর এগুলোর গঠন, প্রকৃতি ইত্যাদি শনাক্তের পর ম্যাপ বা ডিএনএ Blue Print বায়োলজিক্যাল ডাটাবেজে সংরক্ষণ করা হয় । পরবর্তীতে যখনই শনাক্তের প্রয়োজন হয়, তখনই নমুনা সংগ্রহ করে পুনরায় ম্যাপ বা ডিএনএ Blue Print তৈরি করা হয় এবং পূর্বের সংরক্ষিত ডাটার সাথে তুলনা করা হয় । এতে করে সম্পূর্ণ সঠিক ও নিখুঁতভাবে ব্যক্তিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয় । তবে এ পদ্ধতিতে শনাক্তের ক্ষেত্রে খরচ পূর্বের সকল পদ্ধতি থেকে বেশি ।

ডিএনএ পর্যবেক্ষণ ছাড়া সকল পদ্ধতিতেই সুবিধার পাশাপাশি কম- বেশি অসুবিধা পরিলক্ষিত হয় । সাধারণভাবে, স্বাক্ষরের মাধ্যমে ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হলেও আধুনিক প্রযুক্তির যুগে কেবল স্বাক্ষর যাচাই যথেষ্ট নয় । আঙ্গুলের ছাপ বিশ্লেষণ করে পরিচয় শনাক্তের পদ্ধতি বর্তমানে অহরহ ব্যবহার হয় । এ পদ্ধতির খরচও কম। তাই এর ব্যবহার বাড়ছে । ডিএনএ বিশ্লেষণের খরচ অনেক বেশি এবং প্রক্রিয়া কিছুটা দীর্ঘ হওয়ায় ব্যাপকভাবে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা সম্ভব নয় । বিশেষ ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু, অন্য সকল ক্ষেত্রে নিখুঁতভাবে পরিচয় শনাক্তের ভালো উপায় হলো ‘Layer by Layer’ ভেরিফিকেশান পদ্ধতি । স্বাক্ষর, আঙ্গুলের ছাপ যাচাই, চোখের আইরিশ স্ক্যান ইত্যাদি কয়েকটি পদ্ধতির সমন্বয়ে ব্যক্তিকে যাচাই করা হলে নিখুঁত ফলাফল পাওয়া সম্ভব । ইমিগ্রেশান, পাসপোর্ট তৈরি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই লেয়ার ব্যবহার করে ব্যক্তিকে শনাক্ত করা হয় ।

সাধারণত মৃতদের শনাক্তকরণ, মাতৃত্ব বা পিতৃত্ব শনাক্তকরণ, জাতীয় পরিচয়পত্র বা পাসপোর্ট বা ভিসা তৈরি, আইসিটি যন্ত্রে লগিন ইত্যাদি ক্ষেত্রে পরিচয় শনাক্তের উপরোক্ত এক বা একাধিক পদ্ধতি ব্যবহৃত হয় । ভবিষ্যতে পরিচয় শনাক্তের পদ্ধতি আরো উন্নত হবে, আরো চমকপ্রদ, সহজ ও সাবলীল হবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা ।

Similar Posts