প্রাত্যহিক জীবনের নাটকীয় ব্যাখ্যা

সাধারণ অর্থে একজন অভিনেতা বলতে আমরা তাঁকেই বুঝি যিনি বিভিন্ন চরিত্র তাঁর অভিনয় শৈলীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। কখনো ভেবে দেখেছেন যে বাস্তব জীবনে আমরাও পটু অভিনেতার মত প্রতিনিয়ত অভিনয় করছি কিনা? ঠিক একথাটাই ভেবেছিলেন কানাডীয়ান-মার্কিন লেখক এরভিং গফম্যান (১৯২২-১৯৮২)। তিনি ২০০৭ সালে দি টাইমস হায়ার এডুকেশন কতৃক মানবিক ও সামাজিক বিজ্ঞানে সর্বাধিক উদাহৃত লেখকদের মাঝে ৬ষ্ঠ নির্বাচিত হন।

গফম্যানের মতে সামাজিক মিথস্ক্রিয়াকে থিয়েটারের পারফর্মেন্সের সাথে তুলনা করা যায়, মানুষ দৈনন্দিন জীবনের অভিনেতা, সবাই আলাদা আলাদা ভুমিকা পালন করছে ঠিক যেমনটা থিয়েটারের অভিনেতারা করে থাকেন। আর এখানের দর্শক হলো অন্য লোকেরা যারা কাউকে রোল প্লে করতে দেখছে এবং বিভিন্নভাবে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। থিয়েটারের মতই আমাদের সামাজিক জীবনে রয়েছে “ফ্রন্ট স্টেজ” ও “ব্যাক স্টেজ”।

গফম্যানের তত্ত্বে কেন্দ্রীয় ধারণা হলো যে মানুষ  যখন সামাজিক জীবনে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে তারা “impression management” প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকে, যার মধ্য দিয়ে প্রত্যেকে নিজেকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে এবং এমন আচরণ করে যাতে করে তাকে কিংবা অন্যদের যাতে লজ্জিত না হতে হয়।  এর কারণ একটা সামাজিক পদ্ধতিতে সবার মাঝে সামাজিক অবস্থার একটি সাধারণ সংজ্ঞা থাকে, যার ফলে সবাই জানে বিশেষ অবস্থায় কোন বিশেষ আচরণটি গ্রহণযোগ্য, আর উক্ত পরিস্থিতিতে মানুষ তার কাছ হতে কিরূপ আচরণ আশা করে। নিশ্চয়ই আপনি কারো শ্রাদ্ধে গিয়ে খুশিতে নাচাবেন না কিংবা চেষ্টাও করবেন না কারণ আপনি জানেন এই পরিস্থিতিতে আপনার এই আচরণ গ্রহনযোগ্য নয়।

পারফর্মেন্স 

গফম্যান ‘পারফর্মেন্স ‘  শব্দটি ব্যবহার করেছেন মানুষের ঐসকল কার্যাবলী বোঝাতে যা তারা বিশেষ পর্যবেক্ষক বা দর্শকের সামনে উপস্থাপন করে। এই পারফর্মেন্স  এর দ্বারা ব্যক্তি অথবা অভিনেতা নিজের অবস্থা তাঁর দর্শকের সামনে উপস্থাপন করে থাকেন। এই পারফর্মেন্স অন্যদের কাছে এক ধরনের প্রভাব সৃষ্টি করে, যা সেই পরিস্থিতিতে তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে অভিনেতার পরিচয় নিশ্চিত করে। আর অভিনেতা তাঁর পারফর্মেন্স সম্পর্কে সচেতন বা অচেতন থাকতে পারেন, আবার পারফর্মেন্সের নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। অপরদিকে দর্শকেরা ব্যক্তির পারফর্মেন্সকে ক্রমাগত নিজেদের মত ব্যাখ্যা করে। ধরুন আপনার আজ পাশের স্কুলের সাথে গড়ের মাঠে ১২টায় খেলা আছে কিন্তু স্কুল তো ছুটি হবে সেই ৪টায়, আর নতুন হেডস্যারের জ্বালায় পালানোও সম্ভব না। তো আপনি করলেন কি স্যার কে গিয়ে বললেন যে স্যার আমার প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে এবং স্যারকে বোঝাতেও সক্ষম হলেন যে এখন বাড়ি না যেতে পারলে স্কুলেই আপনার মাথা ব্যথায়  ফেটে যাবে। স্যার আপনার কষ্ট বুঝতে পেরে আপনাকে বাড়ি চলে যাবার অনুমতি দিলেন। কিন্তু ব্যাকবেঞ্চে বসা আপনার বন্ধুটি মিটিমিটি হাসছে। কারণ স্যারের কাছে যেটা সত্য আপনার বন্ধুর কাছে সেটা নেহায়েত ভনিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

সেটিংস

পারফর্মেন্সের জন্য মঞ্চ(বিশেষ পরিস্থিতি),সাজসরঞ্জাম ও যেখানে সামাজিক মিথস্ক্রিয়া স্থাপিত হবে। পরিবেশের ভিন্নতার কারণে দর্শক ও আলাদা হয়ে থাকে যার ফলে ব্যক্তিকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে তার পারফর্মেন্সের পরিবর্তন করতে হয়। যেমন ক্লাসে শিক্ষক মহোদয়ের সাথে আমাদের আচরণ আর বন্ধুদের সাথে আচরণের ধরন এক না।

এপিয়ারেন্স

এপিয়ারেন্স সাধারণত ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান অন্যদের কাছে উপস্থাপন করে। এপিয়ারেন্স ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান বা ভুমিকা সম্পর্কেও আমাদের বলে থাকে। আমরা পুলিশের ইউনিফর্ম পরিহিত কাউকে দেখেই বুঝতে পারি উনি কোথায় কাজ করেন আর সমাজে উনার ভুমিকা কি।

ম্যানার

ম্যানার বলতে কিভাবে ব্যক্তি তার ভুমিকা পালন করবেন বা করতে চান তা বোঝায়। এপিয়ারেন্স ও ম্যানারের মাঝে দ্বন্দ্ব ঘটতে পারে যার ফলে শ্রোতা বিভ্রান্ত হতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ যখন কেউ তার অনুভূত সামাজিক অবস্থার বিপরীত কাজ করেন।

ফ্রন্ট স্টেজ,ব্যাক স্টেজ ও অফ স্টেজ

ফ্রন্ট স্টেজে ব্যক্তি অনেকটা আনুষ্ঠানিকভাবে পারফর্ম করে, এমন নিয়ম মেনে চলে যার শ্রোতাদের নিকট বিশেষ অর্থ রয়েছে। অভিনেতা জানে তাকে সবাই দেখছে তাই সে ওইভাবে অভিনয় করে থাকে।
ব্যক্তি যখন ব্যাক স্টেজে যায় তখন সে ফ্রন্ট স্টেজ থেকে ভিন্ন আচরণ করে। ব্যাকস্টেজে ব্যক্তি তার নিজের মত থাকতে পারে এবং ফ্রন্ট স্টেজে অন্যান্য লোকেদের সাথে করা অভিনয় থেকে মুক্তি পায়।
অবশেষে, অফ স্টেজ পারফরমেন্স বলতে বোঝায় যখন ব্যক্তি টিম পারফরমেন্সের বাইরে তার দর্শকদের আলাদা ভাবে সাক্ষাত করে। আর উক্ত পরিস্থিতিতে ব্যক্তির আচার আচরণ (পারফরমেন্স) পরিবর্তন হয়ে যায়।

 

Similar Posts

One Comment

Comments are closed.