মায়াবী জোনাকির স্নিগ্ধ আলোর রহস্য (২য় পর্ব)
জোনাকি পোকা যেহেতু আলো উৎপন্ন করে, তাই অনেকেই ভাবতে পারেন- জোনাকি বুঝি রাতকানা !! রাতে পথ দেখার জন্যই বুঝি জোনাকি আলো তৈরি করে !! বাস্তবে জোনাকি পোকা রাতকানা নয়। অন্ধকারে পথ দেখার জন্য এটি আলো তৈরি করেনা। অন্ধকারেও এই পোকা ঠিকই দেখতে পায়।
জোনাকির আলো হলো জোনাকির ভাষা। আমরা কথা বলে নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করি। কুকুর, বিড়াল, বিভিন্ন প্রজাতির পাখ- পাখালি ইত্যাদি বিভিন্ন রকম শব্দ করে নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান- প্রদান করে থাকে। কিন্তু, জোনাকি তো মানুষের মতো কথাও বলতে পারেনা, অন্য অনেক প্রাণীর মতো শব্দও তৈরি করতে পারে না । তাই জোনাকি পোকা এই আলো তৈরির মাধ্যমেই নিজেদের মধ্যে ভাবের আদান- প্রদান করে । প্রশ্ন হলো- কেবল আলো জ্বালানোর মাধ্যমেই কি ভাবের আদান প্রদান সম্ভব?
আগেই বলা হয়েছে, শ্বাস গ্রহণের সময় অক্সিজেনের প্রভাবে জোনাকি পোকা আলো তৈরি করে। তাই জোনাকি পোকার আলো এক টানা জ্বলে না । একবার জ্বলে, তারপর আবার নিভে। তাই এমন জ্বলা ও নিভার কারণেই জোনাকি পোকার আলো এক ধরনের সিগনাল হিসেবে কাজ করে । সাধারণত সমুদ্রের সিগনাল লাইট বা লাইটার জাহাজের সিগনালগুলোও জ্বলা- নিভার মাধ্যমে সংকেত বহন করে । আবার অত্যাধুনিক বিভিন্ন প্রযুক্তিতে (যেমন- অপটিক্যাল ফাইবার) আলোর সংকেত ব্যবহার করে তথ্য আদান- প্রদান করা হয় । অনুরূপভাবে, জোনাকি পোকাও নিজেদের মধ্যে নিজেদেরই সৃষ্ট আলোক সংকেত ব্যবহার করে ভাবের আদান- প্রদান করে।
বিপরীত লিঙ্গের জোনাকিকে আকর্ষণ করতে এবং শিকারকে আকৃষ্ট করতেও জোনাকি আলো উৎপন্ন করে। পুরুষ জোনাকি উড়ন্ত অবস্থায় আলো জ্বালে তথা আলোক সংকেত পাঠায় । স্ত্রী জোনাকি পোকা তখন ঘাসের উপর, ঝোপের মধ্যে বা ডোবা জাতীয় স্থানে বসে থাকে। পুরুষ জোনাকির পাঠানো আলোক সংকেত স্ত্রী জোনাকির মস্তিষ্কে ধরা পড়ে । স্ত্রী জোনাকিও তখন সেই সংকেতে সাড়া দিয়ে পাল্টা সংকেত প্রেরণ করে। স্ত্রী জোনাকির পাঠানো সংকেত আবার পুরুষ জোনাকির মস্তিষ্কে এসে ধরা পড়ে। পুরুষ জোনাকি তখন সেই সংকেতে সাড়া দিয়ে স্ত্রী জোনাকির কাছে ছুটে যায় এবং তাদের মাঝে বন্ধুত্ব হয়।
একই স্থানে তো বহু সংখ্যক জোনাকি থাকতে পারে। এমতাবস্থায় পুরুষ জোনাকি কিভাবে কোনো নির্দিষ্ট স্ত্রী জোনাকিকে আলোক সংকেত পাঠায় ? কিংবা কোনো স্ত্রী জোনাকিই বা কী করে কোনো নির্দিষ্ট পুরুষ জোনাকিকে সংকেত পাঠায় ? কারণ একই স্থানের সকল জোনাকিই তো আলোক সংকেত তৈরি করছে।
আমরা অন্ধকারে কথা বললেও সাধারণত একজন অন্যজনের কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। কারণ, আমাদের কণ্ঠস্বর ব্যক্তিভেদে আলাদা হয়। আরো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বললে- আমরা সবাই একই রক্ত- মাংসের মানুষ হলেও আমাদের সবার হাতের ছাপ আলাদা, চোখের রেটিনা স্কেনে প্রাপ্ত সংকেত আলাদা । একইভাবে সকল জোনাকি পোকার আলোক সংকেত আলাদা ধরনের হয়ে থাকে । স্ত্রী জোনাকির যে সংকেতটা পছন্দ হয়, সেই সংকেতধারী পুরুষ জোনাকিকেই সে খুঁজে নেয়।
পৃথিবীতে নানা প্রজাতির জোনাকি থাকলেও তারা কেবল নিজের প্রজাতির জোনাকির প্রতিই আকৃষ্ট হয়। আলোক সংকেতের ধরণ দেখেই তারা নিজ নিজ প্রজাতির জোনাকি শনাক্ত করতে পারে।
আজকাল শহরে জোনাকির আনাগোনা খুব একটা দেখা যায়না। সেই তুলনায় গ্রামে সন্ধ্যাবেলায় আজও জোনাকি পোকার ঝাঁক চোখে পড়ে। কারণ শহর এলাকায় তীব্র আলোর কারণে জোনাকি পোকার সৃষ্ট আলোক সংকেত বাধাপ্রাপ্ত হয়। শহরের নাগরিক জীবনে যে পরিমাণ আলো সৃষ্টি হয়, তা যদি আকাশ থেকে দেখা যায়, তবে বহুদূর থেকেও তা পরিলক্ষিত হবে । সেই তুলনায় গ্রাম এলাকায় ঘনবসতি বা শহুরে ঝঞ্ঝাট না থাকায় আলোর প্রখরতা কম হয় । তাই গ্রামে জোনাকি পোকারা স্বাচ্ছন্দ্যে আলোক সংকেত আদান- প্রদান করতে পারে।
জোনাকি পোকা স্রষ্টার সুন্দর এক সৃষ্টি। এর সৌন্দর্য যুগে যুগে মুগ্ধ করেছে কবিদের, আকর্ষিত করেছে প্রকৃতিপ্রেমীদের । অথচ আমাদের নাগরিক জীবনের অতিমাত্রায় কোলাহলের কারণে শহর এলাকায় জোনাকি পোকা আজ প্রায় বিলুপ্ত। শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে বিভিন্ন বন- জঙ্গল ধ্বংস এবং নদী ও ডোবা ভরাটের কারণে জোনাকি পোকার বাসস্থান ও নিরাপদ আশ্রয় কমে যাচ্ছে । অদূর ভবিষ্যতে গ্রামাঞ্চল থেকেও যদি এই প্রাণীটি বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে আমাদের বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আমরাও এর সৌন্দর্য অবলোকন থেকে বঞ্চিত হবো। তাই জোনাকি পোকার নিরাপদ আশ্রয়স্থল গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেয়ার এখনই সময়। এ কাজে প্রকৃতিপ্রেমী ও সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
(সমাপ্ত )