মায়াবী জোনাকির স্নিগ্ধ আলোর রহস্য (১ম পর্ব)

রাতের আঁধারে গাছগাছালি, লতাপাতা, ঝোপঝাড় বা পুকুরপাড়ে পৃথিবীর বুকে তারার মতো জ্বলতে থাকা ছোট্ট প্রাণীটির নাম জোনাকি। এর স্নিগ্ধ আলোয় আমাদের চোখ জুড়িয়ে যায়। জোনাকি সাহিত্যে এসেছে বার বার, হোক সে দেশি সাহিত্য কিংবা বিদেশি সাহিত্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন-

“ও জোনাকি, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ, আঁধার সাঁঝে বনের মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ॥”

জীববিজ্ঞানের গবেষণায়ও জোনাকি যথেষ্ট অবদান রেখেছে। হাজার হাজার জোনাকির আলো কে ব্রিটিশ সেনা বাহিনীর শত্রুশিবিরের আলো ভেবে ভুল করার মতো ঘটনাও ইতিহাসে রয়েছে। এতসব কৌতুহল এবং উদ্দীপনা যেহেতু জোনাকির আলো কে ঘিরেই, তাই এ প্রাণী এবং এর সৃষ্ট আলো সম্পর্কে আজ আমরা জানবো।

জোনাকির আলো

জোনাকি বা Firefly হলো পাখাওয়ালা এক ধরনের গুবরে পোকা। আর্থ্রোপোডা পর্ব এবং কলিওপ্টেরা বর্গের অন্তর্ভূক্ত ল্যামপিরিডি পতঙ্গ পরিবারের একটি সদস্য হলো এই জোনাকি পোকা। এদের জীবনকাল কেবল এক সপ্তাহ থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সীমাবদ্ধ। গ্রীষ্ম এবং নাতিশীতোষ্ণ এলাকায় প্রায় ২ হাজারেরও বেশি জোনাকির প্রজাতি পাওয়া গিয়েছে। ভেজা স্থান বা ডোবা জাতীয় এলাকায় এরা বংশবৃদ্ধি করে । সাগরের তলদেশে অনেক প্রাণী আলো জ্বালাতে পারলেও স্থলভাগে কেবল জোনাকিই এই কাজটি করতে পারে।

জোনাকির আলোর জন্য যে রাসায়নিক পদার্থটি দায়ী তা হলো লুসিফেরিন (Luciferin)। এই লুসিফেরিন যখন অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে, তখন রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। তাই আলো জ্বলে উঠে । লুসিফেরিন এবং অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় আলো উৎপন্ন হওয়াকে বলা হয় বায়োলুমিনেসেন্স। কোনো আল্ট্রাভায়োলেট কিংবা ইনফ্রারেড তরঙ্গ ছাড়াই এরা কোল্ড লাইট বা নীলাভ আলো তৈরি করে । এই আলো হলুদ, সবুজ বা হালকা লালও হতে পারে । আমাদের দেশে সাধারণত সবুজ আলো উৎপন্নকারী জোনাকিদের বেশি দেখা যায়। এই আলোর তরঙ্গ দৈর্ঘ্য প্রায় ৫১০ থেকে ৬৭০ ন্যানো মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

জোনাকির পোকার স্নিগ্ধ আলো
লুসিফেরিন ও অক্সিজেনের বিক্রিয়ায় জ্বলতে থাকা স্নিগ্ধ আলো।

 

জোনাকির দেহে যথেষ্ট পরিমাণ লুসিফেরিন আছে। বায়ুতেও অক্সিজেন অফুরন্ত । তাহলে জোনাকির আলো একটানা না জ্বলে বারবার জ্বলে আর নিভে কেন? মূলত জোনাকি যখন শ্বাস গ্রহণ করে, তখন এটি বায়ু থেকে অক্সিজেন নিজের শরীরে প্রবেশ করায় । তখন লুসিফেরিন এবং অক্সিজেনের বিক্রিয়া ঘটে । ফলস্বরূপ আলো জ্বলে উঠে। এরপর জোনাকি কার্বন- ডাই- অক্সাইড ত্যাগ করে । তখন অক্সিজেনের অভাবে বিক্রিয়া ঘটতে পারেনা । আর তাই আলো জ্বলেনা । অর্থাৎ, শ্বাস গ্রহণের সময় অক্সিজেনের প্রভাবে আলো জ্বলে। শ্বাস ত্যাগ করার সময় অক্সিজেনের অভাবে আলো নিভে যায়। শ্বাস গ্রহণের সময় জোনাকি কতটুকু অক্সিজেনে নিয়েছে, তার উপর বিক্রিয়ায় সৃষ্ট আলোর তীব্রতা নির্ভর করে।

বাসা- বাড়িতে যখন বাল্ব জ্বালানোর হয়, তখন আলোর সাথে তাপও উৎপন্ন হয়। বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বালানোর প্রায় আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাল্বটা ভীষণ রকম গরম হয়ে উঠে । এনার্জি সেভিং বাল্বগুলোতেও তাপ উৎপন্ন হয় । তবে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে এসব বাল্বে উৎপন্ন তাপের পরিমাণ কম। তাহলে জোনাকি পোকা যে আলো তৈরি করে, তাতেও কি তাপ রয়েছে ? তাপ থাকলে সেই তাপের প্রভাবে জোনাকি পোকা পুড়ে যায়না কেন?

আমরা বাসা- বাড়িতে যেসব বাল্ব ব্যবহার করি, এগুলোতে তড়িৎ শক্তিকে আলোক শক্তিতে পরিণত করা হয়। আলোক শক্তি, তড়িৎ শক্তি থেকে উৎপন্ন হলেও পুরো তড়িৎ শক্তির অল্প পরিমাণই আলোক শক্তিতে রূপান্তর হয়। সাধারণ বৈদ্যুতিক বাল্বে যে পরিমাণ বৈদ্যুতিক শক্তি সরবরাহ করা হয়, তার মাত্র ১০ শতাংশ আলোক শক্তিতে রূপান্তর হয়। বাকি ৯০ ভাগ শক্তিই তাপ শক্তিতে পরিণত হয়ে যায় । এ কারণে বাসা- বাড়িতে ব্যবহৃত বাল্ব থেকে অনেক পরিমাণে তাপ বিকিরণ হয়। কিন্তু, জোনাকি পোকার আলোতে কোনো ধরনের বৈদ্যুতিক শক্তির প্রয়োজন হয় না। লুসিফেরিন যখনই অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে, তখনই আলো উৎপন্ন হয়। এখানে বিক্রিয়ক থেকে কোনো শক্তির অপচয় ঘটছেনা, পুরোটাই আলোক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে। তাই জোনাকি পোকা আলো তৈরি করার সময় কোনো ধরনের তাপ উৎপন্ন হয় না। ফলে জোনাকি পোকার কষ্ট হওয়া বা পুড়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে না।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

Similar Posts