মোঘল স্থাপত্যকলার এক অসাধারণ নিদর্শন: দিল্লি জামে মসজিদ
ভারত উপমহাদেশ। কালক্রমে কত শাসকের অধীনে ছিল এই ভূখণ্ড। তার মধ্যে বেশ উল্লেখযোগ্য হল মোঘল শাসনামল। সম্রাট বাবর, হুমায়ুন, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, আকবরদের নাম আজো জ্বলজ্বল করছে ইতিহাসের পাতায় ৷ লাল কেল্লা, দিল্লি জামে মসজিদ, জাফর মহল, হুমায়ুনের সমাধিক্ষেত্র, খান-ই-খানার সমাধি, ফতেহপুর মসজিদসহ শত শত অসাধারণ সব স্থাপত্যশৈলী মোঘল শাসনামলের নিদর্শন। তারমধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে “দিল্লি জামে মসজিদ”।
১৭শ শতাব্দীতে সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে চাঁদনি চকের পাশে অবস্থিত লাল কেল্লার বিপরীতে ভারতের রাজধানী দিল্লির পুরাতন দিল্লি অংশে নির্মিত হয়েছিল ‘মসজিদ-ই-জাহান নুমা’, বর্তমানে যা দিল্লি জামে মসজিদ নামে বিশ্বখ্যাত।
মসজিদ নির্মাণের নেপথ্যের ইতিহাস
সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে বর্তমান দিল্লি শহরের নাম ছিল শাহজাহানাবাদ। সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিককে সাথে নিয়ে ১৬৪৪ সালে এই মসজিদ নির্মাণের কাজ শুরু হয়৷ ১২ বছর পর (১৬৫৬ সাল) শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে নির্মিত হয় “দিল্লি জামে মসজিদ “। বর্তমান অর্থের হিসাবে এই মসজিদ নির্মাণে মোট ১০ লাখ রূপি খরচ হয়েছিল৷ ১৬৫৬ সালের ২৩ জুলাই ছিল পবিত্র ঈদুল ফিতর। আর সেই দিন নামাজ আদায়ের মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় এই ঐতিহাসিক মসজিদের।
সে সময়কার ইসলামী জ্ঞানচর্চার গুরুত্বপূর্ণ নগরী বুখারার ইমাম আব্দুল গফুর শাহ বুখারী সম্রাটের নিকট হতে মসজিদের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যোগদানের আমন্ত্রণ পান। সম্রাটের আমন্ত্রণ রক্ষার্থে তিনি প্রায় প্রায় ১,৮০৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দিল্লি এসে পৌঁছান। তিনি ছিলেন দিল্লি জামে মসজিদের প্রথম ইমাম৷ পরবর্তীতে, তার বংশধরগণ ইমামা হিসেবে এই মসজিদের দায়িত্ব পালন করতে থাকে৷ দিল্লি জামে মসজিদের বর্তমান ইমাম মাওলানা সৈয়দ আহমেদ বুখারীও আব্দুল গফুর শাহ বুখারীর বংশধর।
মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছে লাল বেলে পাথর এবং সাদা মার্বেল দিয়ে। মসজিদটিতে রয়েছে ৩টি নয়নাভিরাম প্রবেশদ্বার। মসজিদ এলাকার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬১ ফুট এবং প্রস্থ ৯০ ফুট। তাছাড়া, দিল্লি জামে মসজিদ ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতায় নির্মিত হয়েছে। প্রায় ৩৫ টি সিঁড়ি পাড় করে আপনাকে প্রবেশদ্বার দিয়ে প্রবেশ করতে হবে। তাছাড়া, এই মসজিদে আপনি আরো পাবেন ৩টি মার্বেলের তৈরি গম্বুজ, ৪টি টাওয়ার এবং ২টি মিনার। দিল্লি জামে মসজিদে একসাথে প্রায় ২৫,০০০ মানুষ নামাজ আদায় করতে পারে৷ তাছাড়া, মহিলাদের নামাজ আদায়ের জন্য রয়েছে বিশেষ সুব্যবস্থা।
মসজিদের সাথে একটি মাদ্রাসা থাকলেও ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার জামে মসজিদ ক্রোক করে দেয় এবং মাদ্রাসাটি তখন ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এমনকি ব্রিটিশ সরকার মসজিদটি পর্যন্ত ধ্বংস করার নীল নকশা বুনন করেছিল। কিন্তু, ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা তাদের মসজিদ ধ্বংসের পরিকল্পনা সফল হতে দেয়নি।
মসজিদে সন্ত্রাসী হামলা
২০০৬ সালের ১৪ এপ্রিল। সেদিন ছিল ঈদে মিলাদুন্নবীর পর প্রথম শুক্রবার। তাই, জুমার নামাজ আদায়ের জন্য আসা মুসল্লির সংখ্যাও সেদিন বেশি ছিল। দিল্লি জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে দুটি ভয়াবহ বোমার বিস্ফোরণ। প্রথম বোমা বিস্ফোরণ হয় বিকেল ৫টা বেজে ২৬ মিনিটে। তার ঠিক ৭ মিনিট পর আবার বোমা বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে মসজিদ প্রাঙ্গন। বোমা বিস্ফোরণে মসজিদের কাঠামোর কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলে ১৩ জনের মত মুসল্লি আহত হয়।
২০১০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর দুঃখজনকভাবে আবার এই ঐতিহাসিক মসজিদটিকে অপ্রীতিকর ঘটনার সাক্ষী হতে হয়। উল্লেখ্য দিনটিতে হঠাৎ মোটরসাইকেল আরোহী দুই বন্দুকধারী একটি ট্যুরিস্ট বাসকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করে। এই ঘটনায় ২ জন তাইওয়ানিজ নাগরিক আহত হয়।
দিল্লি জামে মসজিদ ও পর্যটন শিল্প
বিভিন্ন দেশ থেকে আসা পর্যটকদের জন্য এই মসজিদের নির্দিষ্ট স্থানে রয়েছে বনভোজন আয়োজনের ব্যবস্থা। মসজিদের দক্ষিণের মিনারটি পর্যটকদের উন্মুক্ত তবে এর জন্য অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট অংকের ফি বরাদ্দ রয়েছে। সাঁঝের দিকে মাগরিবের নামাজের পর মসজিদে আলোকসজ্জাও বেশ উপভোগ্য। চাঁদনি চক বাজার, লাল কেল্লা, ফতেহপুর মসজিদ,গৌরি শংকর মন্দির, স্টিফেন এর গির্জা, গুরুদুয়ারা শিশগঞ্জ সাহেবের মত বিখ্যাত পর্যটন স্থানগুলো এই মসজিদের ২ কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত।
যদিও মোঘল শাসনামল শেষ হয়েছে অনেক আগেই কিন্তু তাদের নির্মিত দিল্লি জামে মসজিদ বহন করে চলেছে হাজার বছরের ইতিহাস। ধর্মীয় বিশ্বাস আর ইতিহাসের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ “দিল্লি জামে মসজিদ”।