সাদ ইবনে রহমান / জানুয়ারী 2, 2021
জেট ল্যাগ হলো শরীরের পর্যায়ক্রমিক কার্যক্রম বা ব্যবস্থা বিঘ্নিত হয়ে যাওয়া । টাইম জোন এর পরিবর্তন কিংবা শিফট ওয়ার্ক এর কারনে এই সমস্যা অনেকের দেখা যায়। আমাদের শরীরে সব কিছুই নির্দিষ্ট সময়ে সংগঠিত হয় । আমরা দুপুর বেলায় প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত থাকি । কিংবা রাতের বেলাই আমাদের ঘুম আসে । একটু খেয়াল করলেই বুঝা যাবে যে দিনের নির্দিষ্ট সময় ছাড়া আমাদের তেমন ক্ষুধা লাগে না । এর কারন আমাদের শরীর এই অভ্যাসের সাথে মানিয়ে নিয়েছে। এটাকে আসলে বলে বায়োলজিক্যাল ক্লক বা বডি ক্লক । এই বডি ক্লক এর সময় অনুসরেই আমাদের শরীরবৃত্তীয় কাজ নির্দিষ্ট সময় সংগঠিত হয় । এই শরীর বৃত্তীয় কাজে যখনি ব্যাঘাত ঘটে তখনি জেট ল্যাগ অনুভূত হয় ।
এক কোথায় বলতে গেলে জেট ল্যাগ হল টাইম জোন সিনড্রোম । মানে পৃথিবী এক টাইম জোন থেকে অন্য কোনো টাইম জোনে ভ্রমন করলে শরীরের পর্যায়ক্রমিক কার্যকালাপের বিঘ্ন ঘটে । আমরা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন এ ঘুমাই । সঠিক ঘুমের অভ্যাস থাকলে আমাদের রাতে নির্দিষ্ট সময় ঘুম আসে । এবং সকালে একই সময়ে আপনা আপনি ঘুম ভেঙে যায় । এটাই হলো আমাদের স্লীপ প্যাটার্ন । আপনি হয়তো এমন এক টাইম জোনে এসে পড়লেন যেখানে আপনার আগের থাকা স্থান অনুযায়ী সকাল বা রাত হওয়ার কথা ছিলো । কিন্তু নতুন স্থানে ভ্রমন করতে এসে দেখলেন সেখানে ঠিক উল্টো সময় ।
তখনি আপনার জেট ল্যাগ দেখা দিবে । আমাদের মস্তিষ্কে একটা টাইম সেট করা থাকে । সেই টাইম অনুসরেই আমাদের ঘুম, খাওয়া ইত্যাদি পর্যায় ক্রমে নির্দিষ্ট সময় অনুসরে পরিচালিত হয় । আমারা কোন সময় রাতের ঘুম দিনে সেরে ফেলতে পারি না । কিংবা দিনে রাতের ঘুম চলে আসে না। এটাই আমাদের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রন করে। কিন্তু এক অঞ্চল থেকে দুরের কোন অঞ্চলে ভ্রমন করলে সময়ের পার্থক্যের কারনে মস্তিষ্কের বাঁধাধরা সময়ের ওলটপালট হয়ে যায়। মস্তিষ্ক হিসেব করে পূর্বে থাকা টাইম জোন অনুসরে । ফলে মাথা ধরা, ক্লান্ত অনুভব করা, নিস্তেজ হয়ে যাওয়া এসব সমস্যা দেখা দেয় । এটাই মূলত জেট ল্যাগ।
রাতের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলেও জেট ল্যাগ এর লক্ষণ দেখা দেয় । যতো তাড়াতাড়ি টাইম জোন পার করা হবে ততোই জেট ল্যাগ এর লক্ষণগুলো প্রকট হবে । বৃদ্ধ মানুষের এই সিনড্রোম অল্পতেই দেখা দেয় । এবং সেরে উঠতে সময় লাগে । শিশুদের সামান্যই এই লক্ষণ দেখা যায় । তারা তাড়াতাড়ি রিকভার করতে পারে ।
আমাদের মস্তিষ্কের কার্যকালাপ কিংবা মস্তিষ্কের দুই অংশের কোষের ছন্দসমতা বিঘ্নিত হলেই জেট ল্যাগ দেখা যায় । জেট ল্যাগ এর বিষয়টি ভালোভাবে অনুধাবন করতে হলে আগে আমাদেরকে মস্তিষ্কের ছন্দসমতা সম্পর্কে জানতে হবে । একে Circadian rhythms অথাবা the body clock বলেও ডাকা হয় । বডি ক্লক মূলত আমাদের জৈব রাসায়নিক, শারীরবৃত্তীয় এবং আমাদের শরীরের আচরণগত ২৪ ঘণ্টার চক্র । আমাদের খাওয়া-দাওয়া , হাঁটাচলা , ঘুম , শরীরের তাপমাত্রা এগুলো নির্দিষ্ট নিয়মে পর্যায় ক্রমে পরিবর্তিত হতে থাকে ।
আমাদের মস্তিষ্কের দুটি আলাদা গ্রুপের নিউরন গুলোর কার্যকালাপের ঐক্য ধরে রাখতে না পারলে জেট ল্যাগ হয় । এই আলাদা দুটি গ্রুপের নিউরন সুপ্রাচিয়াসমেটিক কাঠামোর অংশ । এই সুপ্রাচিয়াসমেটিক মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস এর নিচে অবস্থান করে । গ্রুপের দুটি অংশের একটি আমাদের গভীর ঘুম এবং শারীরিক অবসাদ নিয়ন্ত্রন করে । আর অন্যটি আমাদের ঘুমের rapid eye movement (REM) নিয়ন্ত্রন করে। অদ্ভুত হলেও এটা সত্যি যে rapid eye movement (REM) পর্যায়ে আমাদের বন্ধ থাকা চোখের পাতার নিচে চোখ অনবরত নড়তে থাকে । এই সময়ই আমরা মূলত স্বপ্ন দেখি ।
তো যাই হোক , জেট ল্যাগ হলে এই REM নিয়ন্ত্রণকারী গ্রুপের নিউরন গুলো অন্য নিউরন যা শারীরিক অবসাদ নিয়ন্ত্রণ করে তার সাথে তাল মেলাতে পারেনা । ফলে এই দুটো নিউরনের গ্রুপ ছন্দছাড়া হয়ে যায়।
আমাদের বডি ক্লক সব সময়ই বাইরের পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয় । কিছু কিছু হরমোন রয়েছে যা বাহ্যিক পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল । যেমন সকালে ঘুম থেকে উঠলে চোখে আলো এসে পড়লে এক ধরণের হরমোন নিঃসৃত হয় যা আমাদের ঘুম কাটাতে সাহায্য করে। তেমনি বাইরের নিয়ামক আমাদের মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে । এবং সেই অনুযায়ী আমাদের শরীরবৃত্তীয় কার্যকালাপ সম্পাদিত হয় ।
ভিন্ন টাইম জোন এ আসলে বাইরের নিয়ামক গুলো পরিবর্তন হয় । ফলে মস্তিষ্কের ছন্দ পতন হয় । হয়তো টাইম জোনের পরিবর্তনের কারনে যখন রাত থাকার কথা তখন দিনের আলো থাকে । এই বাহ্যিক প্রভাবই জেট ল্যাগের কারন । স্লীপিং ডিসঅর্ডার কিংবা নাইট শিফট ওয়ার্কের কারণেরও অনেক সময় এই সমস্যা দেখা যায় ।
জেট ল্যাগ হওয়ার লক্ষণ একেক জনের ক্ষেত্রে একেক রকম হতে পারে । পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম কিংবা পশ্চিম থেকে পূর্বে প্লেনে ভ্রমন করলেই সাধারণত এই লক্ষণ দেখা যায় । কিন্তু উত্তর থেকে দক্ষিনে অথবা দক্ষিন থেকে উত্তরে গেলে জেট ল্যাগ এর লক্ষণ প্রকাশ পায় না । তবে সিজন পরিবর্তনের কারনে কিছু সমস্যা দেখা দিলেও সেটা জেট ল্যাগ নয় । বলে রাখা ভালো যে কয়েক ঘণ্টা টাইম জোনের পরিবর্তনের কারনে জেট ল্যাগ হয় না ।
জেট ল্যাগের কয়েকটি লক্ষণ হলো –
বাহিরের ফ্যাক্টর বা নিয়ামক গুলোর ওপর নির্ভর করে কতোটা প্রকট ভাবে এই লক্ষণ দেখা দিবে । বেশি টাইম জোন অতিক্রম করলে লক্ষণ আরও গাড় ভাবে দেখা দেয়। এই লক্ষণ গুলো বয়সের ওপর নির্ভরশীল ।
বর্তমানে জেট ল্যাগ এর তেমন কোন প্রতিকার নেই । নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া , ঘুম , হাঁটাচলা এটিকে প্রশমিত করে । যে ব্যক্তি নিয়ম মেনে চলে, ঠিক মতো রেস্ট নেয় তাদের ক্ষেত্রে এই রোগ কম দেখা যায় । হার্ট , ডায়বেটিক্স অথবা ফুসফুসের রোগ যাদের আছে তাদের ক্ষেত্রে আরও প্রকট আকার ধারন করে । এক্ষেত্রে কোন দূর দেশে যাত্রার পূর্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত ।
এটি প্রতিকার করা না গেলেও প্রতিরোধ সম্ভব । এইরকম কিছু টিপস হল –
এক গবেষণায় দেখা গেছে যে দীর্ঘ আকাশ ভ্রমনের ক্ষেত্রে সানগ্লাস ব্যাবহার করা জেট ল্যাগ প্রশমিত করতে পারে । সানগ্লাস অনবরত পরিবর্তন হওয়া লাইট প্যাটার্ন পরিবর্তিত করে আমাদের মানিয়ে নিতে সাহায্য করে । মেলাটোনিন হরমোন জেট ল্যাগ কমাতে সাহায্য করে । তবে গবেষকরা মনে করছেন পরবর্তীতে হয়তো ঔষধ প্রয়োগের মাধ্যমে জেট ল্যাগ কে দমন করা সম্ভব হবে । যাদের জেট ল্যাগ এর সমস্যা প্রবল তাদের আকাশ পথে ভ্রমন না করে ভেঙে ভেঙে স্থল পথে যাতায়াত করা উচিত ।
তথ্যসূত্রঃ
https://www.medicalnewstoday.com/articles/165339#what-is-jet-lag
FILED UNDER :ভ্রমণ , লাইফস্টাইল , স্বাস্থ্য কথন
সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ