লেখালেখির সময় যে জিনিসগুলো খেয়াল রাখা উচিত
যখন থেকে মানুষ লিখতে শিখেছে তখন থেকেই লেখালেখির প্রচলন। লেখালেখি কী? লেখালেখি বলতে আসলে গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, নাটক অর্থাৎ লেখার মাধ্যমে নিজের মনের ভাব বা কোনো অভিজ্ঞতা প্রকাশ করা, পাঠক সমাজের কাছে তুলে ধরা। অর্থাৎ বলতে পারি, আমাদের অর্জিত জ্ঞান পাঠক সমাজের কাছে লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ-ই লেখালেখি। আর এই পাঠক সমাজ হলো জনসাধারণ, এমনি লেখক নিজেও একজন পাঠক।
লেখালেখির এক সুন্দরতম দিক হলো, যে কেউ লেখক হতে পারে, যে কেউ লিখতে পারে। কোনো বাধা বিপত্তি নেই। সেই সুবাদে অগুনিত মানুষ লিখেছে, সাহিত্য রচনা করেছে। তার মধ্যে মহান লেখকেরা নিজেদের নিজস্ব কৌশল দ্বারা লেখালেখির ভিন্ন ভিন্ন জগৎ সৃষ্টি করেছেন। তাদের হাত ধরেই কাব্য, মহাকাব্য, উপন্যাস, গল্প, ছোটগল্প, সনেট আর নাটকের পথ চলা শুরু। এত সব লেখককে ২ ভাগে ভাগ করা যায়। এক প্রকার লেখক আছেন যারা নাম- যশের জন্য লিখেন। আবার আরেক ধরনের লেখক হচ্ছে যারা টাকার জন্য লেখে। তবে আমার মতে তারাই মহান হতে পেরেছে যারা পাঠকের জন্য লিখেছেন, সমাজের কল্যাণের জন্য লিখেছেন।
আমরা যে কেউ লেখক হতে পারি, লিখতে পারি। তবে লেখার সময় কিছু জিনিস আমাদের মাথায় রাখা দরকার। নাহ, আমি লেখার কোনো নিয়মের কথা বলছি না। কারণ লেখার কোনো নিয়ম নেই, তবে নিজস্বতা আছে। লেখালেখি হাতে কলমে শেখা যায় না এবং শেখানো যায়ও না। তবে আমি আপনাদের সাথে কিছু অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারি। লেখার মান ধরে রাখতে, নতুন কিছু লেখার জন্য যা আপনাকে কিছু সহায়তা করতে পারে। আগেই একটা কথা জানিয়ে রাখি, সিজনাল লেখক অর্থাৎ যারা হুট করতে লেখতে বসে কিছু একটা লিখেই আবার হারিয়ে যান তাদের সাথে আমার অনেক কথার-ই দ্বিমত হবে। কারণ আমি তাদের জন্য লিখছিও না,যারা লেখালেখিকে ভালোবাসে, লেখালেখির প্রতি মনোযোগ দিয়েছে তাদের জন্যও কিছু কথা লিখা। লেখালেখির সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলো খেয়াল রাখবেন। এতে আপনার কিছু সহায়তা হবে।
১. প্রথমে-ই ব্যর্থতার কথা বলি। আমরা অনেকেই লিখতে বসে ব্যর্থ হয়ে লেখালেখি থেকে দূরে সরে যাই। অনেকের লেখা-ই কোথাও ছাপা হয় না। অনেক নেতিবাচক সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয়। তাদের বলি, ধৈর্য্য ধরুন, সফলতা একদিনে আসে না। সমালোচনা ও ব্যর্থতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখবেন। লেখার পিছনে লেগে থাকুন।
২. আমরা অনেকেই লেখার সময় টপিক খুঁজে পাই না। টপিক বা বিষয়বস্তু আপনার চারপাশেই আছে। প্রকৃতি, আপনার চারপাশের পরিবেশ থেকে টপিকের সন্ধান করুন। যে বিষয় সম্পর্কে ধারনা রাখেন না, সে বিষয় নিয়ে লিখবেন না। এতে লেখা ভালো হয় না।
৩. অনেকের লেখা-ই কোথাও ছাপা হয় না। তাদেরকে বলি, মৌলিক বিষয়বস্তু নিয়ে লেখার চেষ্টা করুন। অধিক লিখিত হয়েছে এরুপ বিষয় এড়িয়ে চলুন। আর লেখা পাবলিশ না হলে হাল ছাড়বেন না, লিখে যান।
৪. অনেকে সঠিক শব্দচয়নের অভাবে ভুগি। আপনারা বেশি বেশি পড়ুন। লেখালেখি শেখার উৎকৃষ্ট উপায় পড়া। বেশি বেশি পড়ুন, নিজরে জ্ঞানের পরিধি বাড়ান। ফ্রি হ্যান্ডে লিখতে পারেন। যা দেখবেন, অনুভব করবেন তাই লিখুন। এতে হাত খোলে।
৫.বাক্য সংক্ষিপ্ত রাখুন। দীর্ঘ বাক্য বুঝতে পাঠকের কষ্ট হয় এবং পড়ার আগ্রহ হারিয়ে বসে। শুধু যে ছোট বাক্য লিখবেন তা কিন্তু বলিনি। ছোট- বড় সব বাক্যের মিশ্রণ ঘটিয়েই লিখুন।
৬. লেখার সময় লেখার টপিক, উদ্দেশ্য বা কাহিনির দিকে মন দিন, ব্যাকরণের দিকে নয়। যে শব্দ প্রয়োজন তা ব্যবহার করতে দ্বিধা করবেন না।
৭. যখন লেখালেখি করবেন তখন তা গুরুত্বের সাথেই করবেন। নিজের ধ্যান-জ্ঞান বানাবেন। হেলায় হেলায় লেখা হয় না, হলেও তা ভালো হয় না।
৮. কোনো কিছু লেখার আগে তা সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখুন। বিষয়বস্তু নিয়ে গবেষণা করে প্রস্তুতি নিন। কোনো কিছু লেখার আগে তা সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ ও তা বুঝা জরুরি। এক্ষেত্রে এই বিষয়বস্তু নিয়ে পুর্বে কোনো লেখা হয়ে থাকলে তাও দেখুন তবে তা অনুকরণ বা নকল করবেন না কোনভাবেই। শুধুমাত্র ধারণা নিবেন।
৯. জ্ঞানের পাণ্ডিত্য দেখাবেন না। লেখাকে বেশি তথ্যবহুল করবেন না। যদি লেখকের ভান্ডারে জ্ঞান থাকে তবে লেখায় তা এমনিতেই প্রকাশ পাবে। জোরপূর্বক জ্ঞান প্রকাশের চেষ্টা করলে তা লেখার মান কমিয়ে দেয় এবং পাঠকের কাছে বিরক্তিকর ঠেকে।
১০. অনেকেই নাম যশের জন্য লিখে, তা করবেন না। যদি লেখা ভালো হয় তাহলে এমনিই নাম যশ হবে।
১১. টাকার জন্যও লিখবেন না। টাকার জন্য লিখতে গেলে লোকসজ্জা বেশি হয়। তা লেখার জন্য ভালো নয়। পাঠকদের জন্য লিখুন। সমাজের, দেশের মঙ্গলের জন্য লিখুন। দেখবেন তাহলে লেখা ভালো হবে।
১২. কোনো কিছু নিয়ে লিখার সময় আগে তা আয়ত্ত করুন সম্পূর্ণভাবে। পরে প্রয়োজন মতো ভেঙে গড়ে নিবেন।
১৩. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটা কথা বলেছিলেন, “যাহা লিখিবেন, তাহা হঠাৎ ছাপাইবেন না। কিছুকাল ফেলিয়া রাখবেন। কিছুকাল পর উহা সংশোধন করবেন। তাহা হইলে দেখবেন, প্রবন্ধে অনেক দোষ আছে। কাব্য নাটক দুই এক বৎসর ফেলিয়া রাখিয়া তারপর সংশোধন করিলে বিশেষ উৎকর্ষ লাভ করে”- আমি দুই এক বছর ফেলিয়া রাখতে বলবো না কেননা আমাদের আজকের যুগে তা মানা কঠিন। তবে সম্ভব হলে মাস দুয়েক ফেলিয়া রখবেন, নাহয় সপ্তাখানেক হলেও। এতে অনেক ভুল বেরিয়ে আসবে।
১৪. অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ বিষয় নিয়ে লিখবেন না। নেতিবাচক লেখা ও মানসিকতা এড়িয়ে চলুন। কেননা ইহা মনের ও চিন্তার উভয়েই সংকীর্ণতার কারণ।
১৫. সমাজে একটা ভুল ধারণা আছে। অনেকেই বলে থাকেন- মাদকে মাথা খোলে। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। মাদক আমাদের চিন্তা চেতনাকে সংকীর্ণ করে তুলে। মস্তিষ্কের ক্ষতি করে। এতে লেখা ভালোর বদলে মন্দ হয় বেশি।
১৬. নিজের লেখার মধ্যে নিজস্বতা আনুন। পাঠকদের জন্য এমন ভাবে লিখুন যা তারা অন্য কোথাও পায় না। আপনার লিখা-ই যেন আপনার পরিচয় বহন করে। লেখার মধ্যে নিজস্ব একটা কৌশল থাকবে যা পাঠক বুঝতে পারবে কিন্তু ধরতে পারবে না। এতে আপনার লেখার প্রতি পাঠকের আগ্রহ বাড়বে।
১৭. কখনো কারো লেখা অনুকার বা নকল করবেন না। কারো লেখা নকল করে বেশি দূর এগোতে পারবেন না। আমাদের সমাজে অনুকার বেড়ে গেছে বলেই লেখার মান নিচে নেমে গেছে।
অনেক কথাই বললাম। সবশেষে আর একটা কথা বলেই ইতি টানছি। পড়ুন!!! বেশি বেশি পড়ুন। মনে রাখবেন, একজন পাঠক আর একজন লেখকের পড়া কিন্তু এক নয়। লেখক লেখা পড়ে ভাবে, প্রশ্ন করে,তার উত্তর খুজে বের করে। তাই আবারও বলি,বেশি করে পড়ুন। বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখকদের বই পড়ুন। তাদেরকে-ই নিজের শিক্ষক বানিয়ে নিন। তাদের বই পড়ে নিজের রুচিকে সমৃদ্ধ করুন। তবে তাদের লেখার অনুকরণ করবেন না। নিজস্বতা বজায় রেখে লিখে যান। অবশ্যই আপনার লেখা ভালো হবে।
নতুন লেখকেরা অনেকসময়ই এ বিষয়গুলো বুঝতে পারে না!
পড়া দরকার সবচেয়ে বেশি, সে সাথে লিখালিখির চর্চাও চালিয়ে যাওয়া উচিত!