অপেক্ষা

রাজশাহী শহরের বুকে যেমন পদ্মা বহমান, ছুটে চলছে তার গতিতে, ঠিক তেমনি ভাবে ছুটে চলছে তাফিয়া নামে একটা চঞ্চল, ছটফটে প্রাণ। মেয়েটি বড্ড দুরন্ত। তবে মন থেকে সে তেমনি ভালোও বটে। সে পড়ছে ইন্টারে এবং এর মধ্যে প্রেমেও পড়েছে।

পড়াশোনা, প্রেম সব ঠিক ভাবে মেইনটেইনও করছে। চঞ্চল হলে কি হবে? গুণ আছে বলতে হয়। ছেলেটা তার সাথেই পড়ত।এসবের মাঝে সময় তো আর থেমে থাকে না, তাই না?

অপেক্ষা

তাদেরও সময় চলেই যায়। ইন্টার পরিক্ষাও চলে এলো। তারা দুজনে পরিক্ষা দিচ্ছে। ভালো ও হচ্ছে তাদের পরিক্ষা। কেনই বা হবে না? প্রেমের পাশাপাশি পড়াশোনা ঠিকমতোই করত তারা। এক সময় পরিক্ষা শেষ হয়।। তারা দুজন ভার্সিটি কোচিং এ ভর্তি হয়।তাফিয়া কে রাজশাহী ছেড়ে তার পরিবার দূরে যেতে না দিলেও, সে ছেলেটা কোচিং করতে গেছে ঢাকাতে। ওহ! ছেলেটার তো নাম ই বলিনি।

তার নাম রঙ্গন। তাফিয়া ভালোবেসে তাকে রাঙ্গা বলে ডাকত।

দুজন দূরে গেলেও ভালোবাসা চলছেই । সাথে তুমুল পড়াশোনা। দুজন ই নানা জায়গায় পরিক্ষা দিলো। ভাগ্য হয়ত তাদের এক সাথে রাখবে না ঠিক করে রেখেছিলো। তাই দুজন দুই জায়গায় চান্স পেলো। এক ক্যাম্পাসে থাকা হলো না তাদের। ভালোবাসা তো আর দূরত্ব মানে না তাই না?

তাদেরও মানেনি। প্রেম চলছে তাদের। তাফিয়া নতুন ক্যাম্পাসে এসে নতুন পরিবেশের সাথে পেলো নতুন অনেক বন্ধু। তাফিয়া আর রঙ্গন এর সম্পর্ক ভালো চললেও আজ কাল প্রায় তাদের ঝামেলা হয়। যা আগে হতো না। পরে ঠিক ও হয়ে যেতো। তবে বেশিরভাগ সময় ভুল স্বিকার করে নিত তাফিয়া। আর ভাবত রঙ্গন কেমন যেনো একটু পালটে যাছে। এসবের মাঝে তাফিয়ার হঠাৎ মিশকাত নামে এক মেয়ের সাথে খুব বন্ধুত্ব জমে ওঠে।

মিশকাত,তাফিয়া মিলে ভালোয় সময়  পার করছে। তার মধ্যে মিশকাত এর আরো কিছু বন্ধু ছিলো যাদের সাথে তাফিয়ার ও ভালো বন্ধুত্ব হয়। মিশকাত এর বাড়ি কিন্তু ক্যাম্পাসের পাশেই। মিশকাত আর তাফিয়া এত ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে যে এক পর্যায়ে তাফিয়া মিশকাত এর সাথে তার বাসায় থাকতে শুরু করে।

এদিকে রঙ্গন এর সাথে ঝামেলা দিন দিন বাড়ছে। এক পর্যায়ে এত ঝামেলা দেখে মিশকাত তাফিয়া কে বলল সম্পর্কের ইতি টানতে। আসলেই এত অশান্তি নিয়ে থাকা যায় না। শেষ বার যখন তাদের ঝগড়া হয়েছিলো তাফিয়া বলেছিলো আলাদা হওয়ার কথা রঙ্গন তা এক কথায় মেনে নিয়েছিলো। তখন তাফিয়া বুঝতে পারে রঙ্গন আসলে তাই চাইছিলো।

এখন প্রায় ই মন খারাপ করে থাকে তাফিয়া। যখন বের হয় আড্ডা দেয় মিশকাত আর তাদেরই অন্য বন্ধু গুলোর সাথে।তাদের মাঝে নির্ঝর নামে এক ছেলে ছিলো। যে মনে মনে তাফিয়া কে পছন্দ করত। কিন্তু মিশকাত এর কাছে শুনেছে সে অন্য কাউকে ভালোবাসে।তাই কখনো বলে নি। আজ কাল তাফিয়ার মন খারাপ দেখে মিশকাত এর কাছে জানতে পারে নির্ঝর যে, তাফিয়ার সম্পর্ক টা আর নেই। তাই আজ কাল তার মন খারাপ থাকে। অবশ্য মনে মনে নির্ঝর খুশিই হয়েছে। অন্তত তাফিয়া কে ভালবাসার একটা সুযোগ তো পাবে।

এভাবে ধীরে ধীরে তাফিয়ার সাথে কথা,গল্প,সময় কাটানো সব সব বাড়িয়ে দেয় নির্ঝর। মাঝে মাঝে তাদের সার্কেল ছাড়া ওরা দুইজন একা দেখা করে বসে আড্ডা দেয়। এক সময় তারা ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে কথা ও বলতে থাকে।

তাদের বাকি বন্ধু দের সাথে তাদের একটু কম ই এখন কথা হয়। একদিন মিশকাত তাফিয়া কে জিঙ্গেস করলে সে বলে এমন কিছুই না। তারা শুধু বন্ধু।এ কদিন হঠাৎ নির্ঝর তাকে বলে দিলো যে, সে তাকে ভালোবাসে। কিন্তু তাফিয়া তখন ও এমন কিছু ভাবেনি। সে না করে দেয়। কথা বলা বন্ধ করে দেয়। এভাবে কিছুদিন কাটার পর বুঝতে পারে তাফিয়া যে সে ও নির্ঝর কে হয়ত ভালেবেসে ফেলেছে অজান্তে। তাই তার নির্ঝর কে ছাড়া থাকতে কষ্ট হয়। সব টা খুলে বলে মিশকাত কে।

একদিন মিশকাত দুজন কে এক সাথে বসিয়ে দুজনের মান অভিমান ভাঙ্গিয়ে ভাব করে দেয়। শুরু হয় তাদের নতুন প্রেমের গল্প। এর পর থেকে অবশ্য তাদের সব বন্ধুরা এক সাথে সব সময় থাকে,আবার আগের মতো আড্ডা হয়। মাঝে মাঝে মিশকাত রা তাফিয়া আর নির্ঝর কে নিয়ে অনেক মজাও করে। তারাই তো তাদের সার্কেলের এক মাত্র কাপল।

সময় ভালোয় কাটছিলো। হঠাত কোনো এক বিষয় নিয়ে মিশকাত আর তাফিয়ার মাঝে ঝামেলা হয়। অন্যরা সহ নির্ঝর ও চেষ্টা করে ঠিক করার। কিন্তু তা আর ঠিক হয় না বরং বাড়তে থাকে।এ ক পর্যায়ে তাফিয়া মিশকাত এর বাড়ি ছেড়ে চলে আসে। মেসে এসে ওঠে। তাদের এর আলাদা হওয়াটা কেউ ই মেনে নিতে পারছিলো না। সবায় সবার সাথে কথা বললেও মিশকাত আর তাফিয়া কথা বলত না দুজন দুজনের সাথে।এক সময় তাফিয়া তার গ্রুপের সাথে মেশা বাদ দেয়,শুধু নির্ঝর কে নিয়েই থাকে। আরো কিছু নতুন বন্ধু ও হয় তার। নির্ঝর ছিলো খুব নরম প্রকৃতির ছেলে। তাফিয়া ছিলো পুরোই বিপরিত। নির্ঝর এর বলা ছোট ছোটো কথা গুলো ও তাফিয়া খুব কম ই শুনত।।এভাবেই চলছে….

দিন দিন যেনো কেমন হয়ে যাচ্ছে তাফিয়া। আর দিন দিন আরো বেশি করে ভালোবেসে ফেলছে নির্ঝর তাকে। তাফিয়ার সব অন্যায় আবদার কেউ প্রশ্রয় দিচ্ছিলো শুধু হারাবার ভয়ে।হ ঠাৎ ই একদিন তাফিয়া নির্ঝর কে বলে সে আর তার  সাথে থাকতে চায় না। সেদিন পাগলের মতো কান্না করেছিলো নির্ঝর। কিন্তু বোঝেনি তাফিয়া। শোনেনি কোনো কথা। কিন্তু নির্ঝর হাল ছাড়েনি।রেগুলার খোজ নেওয়া,রাগ ভাঙ্গানোর চেষ্টা নির্ঝর করেই যাচ্ছিলো।তা ফিয়া যখন বুঝল নির্ঝর তাকে ছাড়ছে না তখন সব জায়গা থেকে ব্লক করে দেয়………

এদিকে নির্জর তাফিয়ার জন্য পাগল। মিশকাত ও বোঝাচ্ছে নির্ঝর কে। সবার মনে একটাই প্রশ্ন-তাফিয়া এমন কেনো করল??

তখন নতুন সার্কেলের সাথে তাফিয়ার সময় কাটে খুবি ভালো। হইচই করেই কাটে দিন। এদিকে নির্ঝর এক দিন কর জন্যও ভোলেনি তাফিয়াকে। নির্ঝর নিজের মতো করে ভালোবেসে যায় তাকে আড়াল থেকে।

হঠাৎ কেনো এক ছুটিতে ক্যাম্পাস ছুটি হয় সবায় বাড়ি চলে যায়।চতাফিয়ার বাড়ি ক্যাম্পাস থেকে ২ ঘন্টার মতো পথ।্আচর নির্ঝরের বাড়ি অনেক দূর। প্রায় ১ দিন লেগে যায় ট্রেনে। এর মাঝে তাফিয়ার, মিশকাত বা নির্ঝর কারো সাথেই কথা হয়নি।

হঠাৎ একদিন কোনো একটা প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে মেসে আসতে হবে তাফিয়ার। আর ক্যাম্পাস খুলতে আরো প্রায় ১৫ দিন বাকি। তাফিয়া প্রচুর  ভালোবাসত বাইকে করে ঘুরতে। তাই সে তার ভাই এর কাছে বায়না ধরে বাইকে করে ক্যাম্পাস যাবে, এতে তার জিনিস টাও নেওয়া হবে আর ঘোরাও হবে।

যেমন কথা কেমন কাজ। কারন মেয়ে বড্ড জেদি।ভাইয়ের সাথে মেসে এসে তার তার দরকারি জিনিস টা নেয়।হঠাৎ তার মন চায় যদি মিশকাত এর সাথে একটু দেখা হত বা কথা বলত?কেমন হত?

আর হয়ত ঝামেলা নিয়ে বসে থাকতে চায়না তাফিয়া। মেসেজ  করে মিশকাত কে। কিন্তু অভিমান করে উওর দেয় না মিশকাত।হয়ত উত্তর দিলে আজ দেখা করত তাফিয়া তার সাথে। কি আর করার?

ভাই এর সাথে আবার বাড়ি ফিরে আসা ছাড়া উপায় কি? তাই ভাই এর সাথে বাড়ি ফিরতে রওনা দিলো সে। অর্ধেক রাস্তাও যায় নি এখনো ও, হঠাৎ যেনো বিধাতা সব কিছু পালটে দিতে চাইলেন। সামনে থাকে আসা একটা ট্রাক ধাক্কা দেয় তাদের। ছিটকে তার ভাই পাশে পড়ে গেলেও ট্রাক এর সাথে ধাক্কা লেগে রাস্তার উপর ছিটকে পড়ে তাফিয়া।আর একটা ট্রাক এসে তার কোমরের উপর দিয়ে যায়। তার পর ও সে কথা বলছিলো। রাস্তায় কোনো গাড়ি না পেয়ে ৩০ মিনিট এর মতো রাস্তায় পড়ে ছিলো তাফিয়া।তারপর একটা গাড়ি পেলে তাড়াহুড়ো করে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর মাঝে তার ভাই মিশকাত কে বলে রক্তের ব্যবস্থা  করতে কারন অনেক রক্ত পড়েছে তার। রক্তের ব্যাবস্থা করতে করে মিশকাত ও আসছিলে হাসপাতালে  আর তাফিয়াকে নিয়ে তার ভাই ও আসছিলো হাসপাতালে। তখন ও তাফিয়ার জ্ঞান ছিলো। কথা ও বলছিলো। হাসপাতালে পৌছার পর খুব তাড়াতাড়ি তাকে আই সি ইউ তে নিতে বলা হয়……

আই সি ইউ এর সামনে যেতেই তাফিয়া কথা কথা বন্ধ করে, চোখ দুটোও বন্ধ করে।ডাক্তার বলে সে আর নেই……এটা শুনে  তাফিয়ার ভাই মিশকাত কে ফোন করে বলে আর রক্তের দরকার নেই। তখন মিশকাত হাসপাতালের সামনে, সে ভেবেছে রক্ত পেয়েছে হয়ত ………

দৌড়ে আসে মিশকাত উপরে। অনেক আশা নিয়ে, স্যরি বলে তাফিয়াকে জড়িয়ে ধরবে বলে। আর বকবেও ওকে। কিন্তু উপরে এসে তাফিয়ার সাদা কাপড়ে ঢাকা দেহটা দেখার কথা কল্পনায় ও আসেনি মিশকাত এর। সে কেঁদেছে তবে একা। তাফিয়া তাকে জড়িয়ে ধরতে পারেনি।

কি করবে বুঝে পায়নি তখন ও মিশকাত। হঠাৎ মনে পড়ল নির্ঝর কে খবর দেবে ।কিন্তু এসব শুনে কি হবে নির্ঝর এর? তবুও শোনার অধিকার আছে তার। সাহস করে ফোন দিয়েছিলো মিশকাত। বলেও ছিলো। কিন্তু নির্ঝর কোনো কথা বলেনি তখন।চুপচাপ ফোন কেটে দেয়।এদিকে তাফিয়ার রক্ত মাখা,শরীর টা পরিষ্কার করছিলো মিশকাত। আর বলছিলো এমন তো কথা ছিলো না। কয়েক ঘন্টা পর নির্ঝর একটা পোস্ট দেয়,তার আইডিতে…

” এভাবে আমার অপেক্ষার ইতি টেনে দিলে? আমি যে অপেক্ষায় ছিলাম তোমার। বেইমানি করলে? কিন্তু আমি তোমার মতো না। আমি এখন ও অপেক্ষা করব , এ জগতে অপেক্ষা শেষ না হলেও ওই জগতে শেষ হবে আমার অপেক্ষা । সেখানে না হয় দুচোখ ভরে দেখব তোমায়।”

এদিকে মিশকাত নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না এজন্য যে, সেদিন কেনো মেসেজ টার উওর দিলো না। তার যে শেষ বার স্যরি বলে জড়িয়ে ধরা আর হল না।

আজও মিশকাত আর নির্ঝর এর জীবনে অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে তাফিয়া। এখন অবশ্য নির্ঝর তেমন মেশে না কারো সাথে। তার চোখ শুধু বলে এ অপেক্ষার শেষ কবে?

আসলে কিছু অপেক্ষার শেষ এ জীবনে হয় না।

 

 

Similar Posts