বড় ভুঁড়ির পুরুষ আকর্ষণীয় যে জাতিতে
ভুঁড়ি নিয়ে কি বিপাকে পড়েছেন কখনো? বড় ভুঁড়ির জন্য খোঁটা সহ্য করতে হয়েছে? সান্ত্বনা খুঁজে পাচ্ছেন না? তবে জেনে নিন ইথিওপিয়ার একটা বিশেষ জাতি সম্পর্কে, যারা ভুঁড়িকে আকর্ষণীয়তার মানদণ্ড হিসেবে উপস্থাপন করে!
বিস্তৃত সবুজের মাঝে বেশ কয়েকটা খড় ও ঘাস দিয়ে বানানো কুটির। পাশ দিয়ে সরসর করে বয়ে চলছে ওমো নদী। কুটিরগুলোর পাশে রয়েছে গরুর পাল। সেগুলো চড়ে বেড়াচ্ছে, আপন মনে ঘাস খাচ্ছে। গরুগুলোর দেখাশুনা করছে পাথুরে কালো কিছু মানুষ। তাদের শক্তসামর্থ্য উল্কি আঁকা দেহ আর পরনে শুধু একটা চাদরজাতীয় পোশাক।
বলছিলাম দক্ষিণ ইথিওপিয়ার বোডি মি’য়ান জাতির কথা। ইথিওপিয়ার অন্যান্য জাতিগুলোর মত তারাও পূর্বপুরুষের সংস্কৃতিতে বেশ পরিপূর্ণ। কৃষিকাজ আর গরু চড়ানোই তাদের প্রধান জীবিকা। তবে তাদের মধ্যে সবচেয়ে আশ্চর্য যে বিষয়টি, সেটি হচ্ছে- এখানে বড় ভুঁড়ি সবার পছন্দনীয়, যার দেহ যত স্ফীত, সে তত বেশি আকর্ষণীয়!
আমাদের বাইরের মানুষদের কাছে ব্যাপারটা আশ্চর্য মনে হলেও, তাদের কাছে এটা খুবই স্বাভাবিক। আর তারা বাইরের মানুষেরা কী ভাবল, তাতে বিন্দুমাত্রও মাথা ঘামায় না।
প্রতিবছর তাদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এটি হয় সাধারণত জুন-জুলাই এর মাঝামাঝি সময়ে, যখন বৃষ্টির সময় আসে। বৃষ্টির হল ভালো ফসল হওয়ার চিহ্ন, তাই এই আনন্দে তারা ‘খ্যাএল’ উৎসব করে থাকে। এই অনুষ্ঠানেই তাদের সেই বিশেষ প্রতিযোগিতাটা হয়ে থাকে।
পৃথিবীর অন্য কোনো জাতিতে এমন অনুষ্ঠান হতে দেখা যায় না, যেখানে কে সবচেয়ে বৃহৎ দেহের অধিকারী তাকে সম্মানিত করা হয়!
বোডি মি’য়ান জনগোষ্ঠী এই ‘খ্যাএল’ অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে দারুণ উত্তেজিত থাকে। এখানে অংশ নিতে পারে শুধু পুরুষেরা। তাদের লক্ষ্য থাকবে ৩/৪ মাসে দেহটাকে যতটা সম্ভব স্ফীত করা আর অনুষ্ঠানের দিনে নিজেকে উপস্থাপন করা। শরীর বড় করতে তারা শুধু দুধ আর রক্ত পান করে থাকে। কেউ যদি ছয় মাস ধরে চেষ্টা করার সংকল্প করে থাকে, তাহলে তার শরীর অনেক বেশি স্ফীত হওয়ার সুযোগ থাকে।
প্রতিযোগীরা দিনে বেশ কয়েকবার দুধ আর রক্ত পান করে। এগুলো সংগ্রহ করা হয় তাদের গরুগুলো থেকে। প্রতিদিন সূর্য উঠার পর তারা তাদের পানের বৃহৎ এক পাত্র ভরে তরতাজা দুধ পান করে। এর কিছুসময় পর পানি মিশ্রিত দই আর গরুর রক্ত পান করে। রক্তটা খুব দ্রুত পান করতে হয়, নাহলে জমে যায়। কিন্তু অনেক পুরুষই এভাবে পান করতে পারেনা, বিবমিষায় আক্রান্ত হয়।
পান করার জন্য রক্তও সংগ্রহ করা হয় বিশেষ কায়দা করে। তাদের পালনের গরুগুলোর শিরায় বর্শা দিয়ে ছিদ্র করে কিছু পরিমাণ রক্ত সংগ্রহ করে, এরপর মাটির প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। সরাসরি পশুহত্যা করে না তারা, কারণ তাদের কাছে পোষা গরুগুলো খুব প্রিয় আর পবিত্র।
তবে এ পুরুষগুলোর জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং যে বিষয়টা সেটা হল, এই পরিমাণ দুধ আর রক্ত হজম করা। অনেকের শরীরই এতটা নিতে পারেনা। যাদের শরীর নিতে পারে, তাদের দেহ দ্রুত স্ফীত হয়ে উঠে। এভাবে তিন থেকে ছয়মাস তারা প্রতিদিন এরকম প্রস্তুতি নিতে থাকে, এবং একসময় সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ দিনটি চলেই আসে।
খ্যাএল সিরিমোনি!
সেদিন পুরুষগুলোকে একটা পবিত্র গাছ পর্যন্ত হেঁটে যেতে হয় আর কয়েক ঘণ্টা ধরে গাছটার চারপাশে ঘুরতে হয়। শরীরের ভারের জন্য অনেকে হাঁটার শক্তিই হারিয়ে ফেলে, কাজেই এ কাজটা করা তাদের জন্য যথেষ্ট কষ্টকর হয়। তবে এ সময়ে তাদের সাহায্য করে নারীরা। কোমরের দড়ি বেঁধে দেয়া বা ঘাম মুছে দেয়ার মত সেবার কাজটা করে থাকে তারা।
নারী-পুরুষ সবাই বেশ সেজেগুজে আসে। অবিবাহিত মেয়েরা উজ্জ্বল রঙের সাজসজ্জায় উপস্থিত হয়। অংশগ্রহণকারী পুরুষেরা মাথায় শামুকের খোলস আর উটপাখির পালকের মালা পরে। আর গলায় পরে রঙিন নেকলেস। তখন এই বৃহৎ শরীর নিয়ে মাথায় মালার সাথে আটকানো উটপাখির পালক নাড়িয়ে তাদের বিশেষ নৃত্য প্রদর্শন করতে হয়। তাদের নাচ দেখতে দারুণ ভিড় জমে যায়। কানাঘুষো হতে থাকে নানা রকম। কার শরীর সবচেয়ে বড়, কে জিতবে এরকম। কেউ একটু কম স্ফীত হলে সে কি ঠিকমত দুধ পায়নি- এমন টিপ্পনীও কাটে ফিসফিসিয়ে।
নাচ-পর্ব শেষে সবাইকে দাঁড় করানো হয় একটা লাইনে। এরপর বিচারকেরা সবাইকে পরখ করে দেখে কার দেহ সবচেয়ে বেশি স্ফীত। তবে জয়ী হওয়ার জন্য শুধু স্ফীত হলেই চলবে না, শরীর হতে হবে শক্ত, পাথরের মত। থলথলে দেহের অধিকারীর জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিচারকেরা দড়ি দিয়ে পেট আর উরুর মাপের তুলনা করে আর শক্ততা যাচাই করে বিজয়ী নির্বাচন করে।
অনুষ্ঠানের শেষে একটা পবিত্র পাথর দিয়ে আঘাত করে পোষা গরুগুলোর মধ্য থেকে মূল্যবান একটা গরুকে বলি দেয়া হয় আর গোষ্ঠীর অগ্রজরা সে প্রাণীর রক্ত পরখ করে দেখে, যে গোষ্ঠীর ভবিষ্যত কেমন হবে।
এই অনুষ্ঠানের পর তারা আবার স্বাভাবিক খাদ্যাভাসে ফিরে আসে। কয়েক মাস পর শরীরও কমে স্বাভাবিক হয়ে আসে অনেকটা। তবে যে একবার জয়ী নির্বাচিত হয়, সে সারাজীবনের জন্য পুরো গোষ্ঠী থেকে সম্মান পায়। সবাই থাকে ‘হিরো’ হিসেবেই চিহ্নিত করে। ছোট ছোট ছেলেরা স্বপ্ন দেখে একদিন এ সম্মান পাওয়ার।
আর নারীরা পছন্দ করে তাদের। এ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়েই অবিবাহিত নারীরা বিয়ের পাত্র নির্বাচন করে। আর বিজয়ী পুরুষটিও সুন্দরী একটি মেয়ে বাছাই করে সংসার শুরু করতে পারে। তবে পুরুষেরা চাইলে বহুবিবাহও করতে পারে। সাধারণত এক থেকে তিনটি স্ত্রী থাকে অনেক পুরুষের।
বোডি জনগোষ্ঠী স্ফীত দেহকে প্রাচুর্যের চিহ্ন মনে করে। ওইরকম শরীর বানাতে যে পরিমাণ দুধ-রক্ত প্রয়োজন, তার যোগান দিতে একজনের অনেকগুলো গবাদিপশু থাকার কথা। আর যদি নাও থাকে, এর অর্থ তার অনুরাগী অনেক মানুষ রয়েছে, যারা তাকে সাহায্য করেছে। তাই স্ফীত দেহের অধিকারী পুরুষটাকে ধনী আর অনেকের সাথে সুসম্পর্ক রয়েছে- এই হিসেবে চিহ্নিত করা হয় আর একারণে তাদের সম্মানটিও বেশি হয়।
আপনি যদি অনেক স্বাস্থ্যবান হোন, বিশালাকার ভুঁড়ি নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে থাকেন, তবে মনে রাখবেন আপনার পরিচিতজনেরা আপনাকে খোঁচা দিলেও এই বোডি জনগোষ্ঠীর মানুষেরা আপনাকে পেলে সম্মানিত করত!
তথ্যসূত্রঃ
1. https://www.survivalinternational.org/tribes/omovalley
2. https://www.dailymail.co.uk/femail/article-2480870/Ethiopian-Bodi-tribe-big-beautiful-men-compete-fattest.html