ছোট্ট দেশ ভ্যাটিকান ভ্রমণের গল্প (৩)- ভ্যাটিকান আর্কাইভ
অতীতে রাজনৈতিক, ধার্মিক বিভিন্নভাবে ভ্যাটিকান এবং পোপেরা অনেকবার আক্রমণের শিকার হয়েছেন। ইতালি ছাড়াও তৎকালীন পার্শ্ববর্তী দেশ এবং অন্যান্য রাজ্যগুলো প্রায়ই ভ্যাটিকানে আক্রমণ করে বসত। এসব আক্রমণ এড়ানোর জন্য পোপদের সেসময় নিরাপত্তার বিনিময়ে কোন একজন সম্রাট বা রাজার পক্ষাবলম্বন করতে হত। এজন্য পোপেরা সবসময়েই নিজেদের জন্য একটা স্বাতন্ত্র্য রাষ্ট্র চাইতেন। অবশেষে ইতালির শাসক বেনিটো মুসোলিনির সময় ১৯২৯ সালে ভ্যাটিকান একটা নতুন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যদিও ভ্যাটিকানের কিছু সম্পত্তি এবং অধিকৃত ভবন রোমে রয়ে গেছে।
গত পর্বে বলেছিলাম পোপেরা তাদের ক্ষমতা কালে বিভিন্ন মূল্যবান শিল্পকর্ম সংগ্রহ করতেন। তবে তারা শুধু শিল্পকর্মই সংগ্রহ করেননি; বিভিন্ন সময়ে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ লক্ষাধিক দলিল, বই, নিদর্শনও তাদের সংগ্রহে রয়েছে যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত আছে যীশুখ্রিষ্টের সময়ের থেকে শুরু করে পৃথিবীর আরো গুরুত্বপূর্ণ এবং ক্রান্তিকালীন সময়ের নিদর্শন, পোপ নির্বাচন প্রক্রিয়ার ক্রমবিবর্তনের ইতিহাস, চার্চ কর্তৃক সংঘটিত অপরাধ, খ্রিষ্টান ধর্মের অনুসারী দেশগুলোর শাসকদের নেয়া বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের অনুলিপি যা পরে জনসাধারণের ওপরে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালের কিছু ডকুমেন্টস এবং আরো অনেক কিছু। এসব রাখা আছে ভ্যাটিকানের আর্কাইভসে।
আর্কাইভস হচ্ছে লাইব্রেরির সমার্থক শব্দ এবং ভ্যাটিকানের এই লাইব্রেরিতে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র রিসার্চ স্কলাররা বিশেষ অনুমতি সাপেক্ষে এখানে প্রবেশ করতে পারেন। এই লাইব্রেরি থেকে কতোটুকু তথ্য প্রকাশ পাবে সেটা ভ্যাটিকান সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করে। বলা হয়, এই লাইব্রেরিতে এমনও দলিল বা নিদর্শন আছে, যা প্রকাশ পেলে পৃথিবীতে হৈ চৈ পড়ে যাবে। তাই শান্তি রক্ষার্থে যতটুকু জানা মানুষের জন্য মঙ্গলজনক ততটুকুই এখানে হতে প্রকাশ পায়। তবে অতীতে চার্চের নেয়া কোন সিদ্ধান্ত যদি ভুল হয় এবং সেটা সাধারণ মানুষের ক্ষতির কারণ হয়, তবে চার্চ সেটা প্রকাশ করে ক্ষমা চেয়েছে। বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে যা সেইসময় চার্চের প্রচলিত ধ্যানধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। চার্চের প্রিস্টরা জোরপূর্বক তাঁকে তাঁর বক্তব্য ফিরিয়ে নিতে বলে। গ্যালিলিওর প্রতি করা সেই অন্যায়ের বর্ণিত ডকুমেন্ট ভ্যাটিকান আর্কাইভস থেকে পরবর্তীতে প্রকাশ করা হয় এবং তারা এজন্য ভুল স্বীকার করে অনুশোচনা প্রকাশ করে। ভ্যাটিকানের আর্কাইভস নিয়ে তাই মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। বারবার অনুরোধ আসে এমন আরো সত্য উন্মোচনের। বর্তমান পোপ ফ্রান্সিস আশ্বাস দিয়েছেন, খুব শীঘ্রই এই আর্কাইভস থেকে আরো কিছু সত্য প্রকাশ পাবে।
আমেরিকান লেখক ড্যান ব্রাউনের “এঞ্জেলস এন্ড ডেমনস” উপন্যাসটা পড়ার পরেই প্রথম ভ্যাটিকানে যাওয়ার আগ্রহ তৈরী হয়। রহস্য, গুপ্ত সংগঠন, রোম আর ভ্যাটিকানের সুন্দর বর্ণনা এবং প্রফেসর রবার্ট ল্যাঙডনের (উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র) অ্যাডভেঞ্চার এইসব কিছু মিলিয়ে সেটা একটা দারুণ সুখপাঠ্য বই ছিল। এই পুরনো শহরের অলিগলি, রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে প্রায়ই সেসব কাহিনী মনে পড়ে যাচ্ছিল। ভ্যাটিকানে ঘোরার সময় আমি নিজেও দেশটা নিয়ে এতো কিছু জানতাম না। ঘুরে ভালো লাগার পরে দেশটা নিয়ে আরো জানার আগ্রহ থেকে লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে আসি এবং সেই চমৎকার বইটার তথ্যের আলোকেই রোম আর ভ্যাটিকান নিয়ে এই লেখাগুলো লেখা। বইয়ের নাম এবং সাথে তাদের সিরিজের অন্য বইগুলোর জন্যে তৈরী করা ওয়েবসাইটের ঠিকানাটাও নিচে দিয়ে দিচ্ছি।
ভ্যাটিকান দেশটা ছোট হলেও ঘুরতে ভালোই সময় লাগে। আর এই প্যানডেমিকের মাঝে ভ্যাটিকান মিউজিয়াম তাদের অতিকায় সংগ্রহ সবার জন্য ভার্চুয়াল ট্যুরের মাধ্যমে উন্মুক্ত রেখেছে। আর আমার ভ্যাটিকানে ঘোরার গল্প এখানেই শেষ।
তথ্যসূত্র: বই- “Where Is the Vatican” by Megan Stine. Website: www.whohq.com
ভ্যাটিকানের আগের লেখাগুলো যথাক্রমে গ্রীস এবং রোম নিয়ে। সেগুলো নিচের লিংকে গিয়ে পড়া যাবে।
গ্রীস ভ্রমণ (১)- গ্রীক পুরাণ, প্রাচীন সভ্যতা ও আধুনিক গণতন্ত্রের মেলবন্ধন- https://banglavibe.com/travel-to-greece-part-1/
গ্রীস ভ্রমণ (২)- ভূমধ্যসাগরে এক সন্ধ্যা- https://banglavibe.com/travel-to-greece-part-2/
রোমের গল্প (১)- https://banglavibe.com/the-story-of-rome-part-1/
রোমের গল্প (২)- https://banglavibe.com/the-story-of-rome-part-2/