গ্রীস ভ্রমণ (১)- গ্রীক পুরাণ, প্রাচীন সভ্যতা ও আধুনিক গণতন্ত্রের মেলবন্ধন

গ্রীক মিথোলজির বইগুলো এত আকর্ষণীয় সব কাহিনী দিয়ে পরিপূর্ণ যে সেগুলো পড়তে পড়তে গ্রীস ভ্রমণের ইচ্ছা তৈরী হয়। একটা কনফারেন্সে যোগদান উপলক্ষে সে সুযোগটা এসেও গেল তবে কনফারেন্সটা ছিল আমার স্বামীর।

এয়ার ফ্রান্সের প্লেন এথেন্সের কাছাকাছি আসতেই ওপর থেকে গাঢ় নীল ভূমধ্যসাগর, ছোট বড় দ্বীপ আর বিন্দুর মত কিছু জাহাজ চোখে পড়ে। দীর্ঘক্ষণের বিমানযাত্রায় সংকীর্ণ জানালাটা খুললেই বাইরের তীব্র সাদা আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছিল, এতক্ষণ পর দেখা পাওয়া নীল সমুদ্র তাই অনেক প্রশান্তি দিয়েছিল। ছবিতে যেমন দেখা যায়, বাস্তবের গ্রীস আসলে তার চেয়েও বেশি সুন্দর। এথেন্স এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়ে দূরে পাহাড়ের ওপরে এক্রোপলিস, যেটা গ্রীসের একটা গুরুত্বপূর্ণ ল্যান্ডমার্ক এবং একইসাথে একটা ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত সবগুলো দেশেরই ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো ইউরোর বিভিন্ন কয়েন এবং নোটে স্থান পেয়েছে, গ্রীসও তার ব্যতিক্রম নয়।

 

জিউসের মন্দির

 

আমরা চারদিন ছিলাম। জেটল্যাগ কাটিয়ে উঠে কনফারেন্সের ফাঁকে যতটুকু সম্ভব ঘুরেছি। গ্রীকদের প্রাচীন স্থাপত্যকলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন গ্রীক দেবদেবীদের মন্দির ছড়ানো পুরো এথেন্স জুড়ে আর সাথে অনেক মিউজিয়ামও রয়েছে। এসবের একেকটাতে প্রবেশমূল্য অনেক বেশি। তবে ইউরোপ এবং ইউরোপের বাহিরের দেশগুলোর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের জন্য এইসব দর্শনীয় স্থানের টিকিটে ছাড় থাকে। ইউরোপের সব দেশ কিন্তু এই সুবিধা দেয় না। ইউরোপের যে কয়েকটি দেশে ভ্রমণ তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল, গ্রীস তার মধ্যে একটা। এথেন্সের অধিকাংশ স্থাপনাই খুব প্রাচীন, প্রায়ই সেসবে সংস্কার কাজ চলতে থাকে। খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচারের সাথে গ্রীকদের পৌরাণিক দেবদেবীগুলো হারিয়ে যায়। তবে তাদের উদ্দেশ্যে তৈরী মন্দিরগুলো যত্নের সাথে সংরক্ষণের জন্য এখনো টিকে রয়েছে আর সেগুলো দেখতেই বহু পর্যটক ভিড় করেন।

 

হেফাস্টাসের মন্দির

 

শহরের ভেতরে যাতায়াতের জন্য আমরা মেট্রো পাস কিনে নিয়েছিলাম। এথেন্সের যাতায়াত ব্যবস্থা মুগ্ধ করেছে। বাস, ট্রাম আর মেট্রো দিয়ে পুরো শহরটা খুব সুন্দরভাবে সংযুক্ত। আর সেইসাথে সেখানের মানুষের আতিথেয়তা এবং সুন্দর ব্যবহারেও মুগ্ধ হয়েছি। কখনো গুগল ম্যাপের দেখানো রাস্তা বুঝতে সমস্যা হলে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই সে রাস্তা তো বুঝিয়ে দিতই, সাথে নিজে থেকে কিছুদূর এসে দেখিয়েও দিত কোথায় যেতে হবে। মেট্রো স্টেশনগুলো দর্শনীয় স্থানের কাছেই তৈরী তাই খুব বেশি হাঁটার প্রয়োজন পড়ে না। মেট্রোতে, ট্রামে যাতায়তের সময় প্রায়ই পাশে বসা প্রবীণ ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলাটি হাসিমুখে আমাদের দেখে গ্রীকভাষায় কিছু একটা বলে উঠতেন। আমরা কিছু না বুঝলেও হাসিটা ফিরিয়ে দিতাম। ইংরেজি যেখানে চলে না, হাসি সেখানে খুব সহজেই আন্তর্জাতিক ভাষার কাজ করে। আর এতোদিন বইয়ে পড়ে আসা আলফা, বিটা, গামা, ডেলটাসহ অন্যান্য পরিচিত গ্রীক অক্ষরগুলোকে যখন চলতি পথের সব বিলবোর্ড, বাস স্টপেজ, রেস্তোরার মেনুকার্ডে দেখতাম তখন বেশ ভালো লাগত। বইয়ের পাতার বাহিরে তাদের বেশি সুন্দর দেখায়।

 

রাতের এথেন্স

 

দর্শনশাস্ত্র, গণিতবিদ্যা, অলিম্পিক গেমস- গ্রীস পৃথিবীকে অনেক কিছুই দিয়েছে। দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো এবং এরিস্টটল আজো পৃথিবী বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাঁদের বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের জন্য দূরদূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা আসতেন। আর গণিতবিদ পিথাগোরাস, ইউক্লিড এবং আর্কিমিডিসের সূত্র তো গণিতশাস্ত্রে অহরহই ব্যবহার হয়ে থাকে। তবে আধুনিক পৃথিবীর জন্য গ্রীসের সবচেয়ে মূল্যবান উপহার হচ্ছে গণতন্ত্র যার সূচনা হয়েছিল এথেন্সেই আর এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সংখ্যক দেশ এটাকে তাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা হিসেবে বেছে নিয়েছে। ১৮৯৬ সালে আধুনিক অলিম্পিক গেমসের সূচনাও এথেন্সেই হয়েছিল আর সেই প্যানাথেনায়িক স্টেডিয়ামও এথেন্সের একটা আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পট।

(পরবর্তী পর্বে সমাপ্য)।

Similar Posts