ছোট্ট দেশ ভ্যাটিকান ভ্রমণের গল্প (১)-সেইন্ট পিটার’স ব্যাসিলিকা
রোমে ঘুরতে গিয়ে আমরা ভ্যাটিকানের কাছাকাছি একটা এয়ারবিএনবি (যেখানে মানুষ নিজের বাসা অন্যদের অল্প সময় থাকার জন্য ভাড়া দেয়) তে ছিলাম। ভ্রমণের জন্য রোম খুব ব্যয়বহুল একটা শহর। ব্যস্ত, কোলাহলপূর্ণ শহরকেন্দ্রের চেয়ে ভ্যাটিকানের শান্ত, নিরিবিলি নেইবারহুডের ছিমছাম, ছোট্ট বাসাটা আমাদের বেশি ভালো লেগেছিল। বাসার হোস্ট বা মালিক ছিলেন বাঙালী বংশোদ্ভূত এক ইতালিয়ান। এই দূর বিদেশে ক্ষণিকের জন্যেও কারো সাথে বাংলায় কথা বলতে পারা খুব স্বস্তির একটা ব্যাপার। মাত্র নয়দিনের ভ্রমণেও মনে হয়েছিল বহুদিন বাংলায় কারো সাথে মন খুলে কথা বলি না। বাসাটা থেকে ভ্যাটিকান প্রায় হাঁটা দূরত্বে ছিল। তাই প্রথম দিনই চলে গিয়েছিলাম রাতের বেলায় ভ্যাটিকান কেমন দেখায় সেটা দেখার জন্য।
ভ্যাটিকান রোমের ভেতরে হলেও সেটা পুরো রোম শহর থেকে একটা প্রাচীর দিয়ে আলাদা করা আর সেই প্রাচীরের গেট নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় উন্মুক্ত হয়েছে। রাতে ভ্যাটিকানের চার্চ, মিউজিয়াম সবই বন্ধ থাকে। এসময় মানুষের ভিড় কম থাকায় বড় সেইন্ট পিটার’স স্কয়ারটাতে বসে থাকতে বা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে বেশ ভালো লাগে। স্কয়ারের এক কোণায় বসে আমরা দেখছিলাম পৃথিবীর কতো প্রান্তের মানুষই না এখানে ভ্রমণে আসেন! জনগণের উদ্দেশ্যে পোপ যখন ভাষণ দেন তখন চার্চের সামনের এই সেইন্ট পিটার’স স্কয়ারে লাখো মানুষের ঢল নামে। এটাকে ‘’পাপাল অডিয়েন্স’’ বলে। সেটাতে অংশগ্রহণের জন্য আগে থেকে ফ্রি টিকেট কেটে রাখা যায়।
স্কয়ারের সাথেই আছে সেইন্ট পিটার’স ব্যাসিলিকা। ভ্যাটিকান যে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট দেশ সেটা হয়তো আমরা অনেকেই জানি, কিন্তু এই ছোট্ট দেশটার ভেতরেই আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চার্চ- সেইন্ট পিটার’স ব্যাসিলিকা। সেইন্ট পিটার ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মের একজন অনুসারী এবং প্রচারক। তিনি তাঁর সাহসিকতার জন্য অনন্য হয়ে আছেন। রোমান সম্রাটদের সময়ে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রচার নিষিদ্ধ ছিল। নিজের ধর্মবিশ্বাসের প্রতি অটল থাকার জন্য সম্রাট নীরোর আদেশে সেইন্ট পিটারকে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে সম্রাট কন্সট্যান্টিন খ্রিষ্টানধর্ম গ্রহণ করেন এবং ধর্মপ্রচারের নিষেধাজ্ঞা তখন উঠে যায়। সেইন্ট পিটারের সমাধির ওপরে একটা চার্চ নির্মাণ করা হয়েছিল। আরো পরে সেই চার্চ ভেঙে এই বৃহদাকার নতুন চার্চ তৈরী করা হয়।
সেইন্ট পিটার’স ব্যাসিলিকা আর এর সামনের চত্বরটা ইতালির রেনেসাঁ যুগের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শিল্পকর্মগুলোর একটা। সেসময়ের ইতালির বিখ্যাত শিল্পীরা এটা তৈরীতে কাজ করেছিলেন। এর সুউচ্চ ডোম বহুদূর থেকে চোখে পড়ে আর সেখানে থেকে রোম শহরকে অনেকখানি দেখা যায়। আইন অনুযায়ী রোমে এই ব্যাসিলিকার চেয়ে উচ্চতায় বড় কোন ভবন কখনই তৈরী করা যাবেনা। তবে এই নিয়ম শুধু রোমেই নয়, পৃথিবীর আরো কিছু দেশের রাজধানী শহরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতেও ওয়াশিংটন মনুমেন্টের চেয়ে উচ্চতায় বড় কোন ভবন আইন অনুযায়ী তৈরী নিষেধ।
আমাদের মতো পর্যটকদের কাছে ভ্যাটিকান একটা ট্যুরিস্ট স্পট হলেও ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারীদের কাছে সেটা একটা পবিত্র তীর্থস্থান। আমাদের সাথে চার্চে ঢোকার লাইনে এমন বহু মানুষ ছিলেন যাদের এখানে আসার প্রধান উদ্দেশ্যই ছিল চার্চে বসে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করা। চার্চে প্রবেশের আগে তাই বারবার মনে করিয়ে দেয়া হয় ভেতরে পবিত্র নীরবতা বজায় রাখার জন্য। চার্চের ভেতরের সিলিং আর দেয়ালের অনেকাংশ জুড়েই স্বর্ণ এবং ব্রোঞ্জের কারুকাজ করা, ভেতরে তাই সবসময় একটা সোনালি আভা থাকে। চার্চে সময় নিয়ে যাওয়া ভালো কারণ ভেতরে ঢোকার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে হয় আর এতো বড় চার্চ ঘুরে দেখতেও সময় লাগে। (চলবে)
ভ্যাটিকানের আগের লেখাগুলো যথাক্রমে গ্রীস এবং রোম নিয়ে। সেগুলো নিচের লিংকে গিয়ে পড়া যাবে।
গ্রীস ভ্রমণ (১)- গ্রীক পুরাণ, প্রাচীন সভ্যতা ও আধুনিক গণতন্ত্রের মেলবন্ধন- https://banglavibe.com/travel-to-greece-part-1/
গ্রীস ভ্রমণ (২)- ভূমধ্যসাগরে এক সন্ধ্যা- https://banglavibe.com/travel-to-greece-part-2/
রোমের গল্প (১)- https://banglavibe.com/the-story-of-rome-part-1/
রোমের গল্প (২)- https://banglavibe.com/the-story-of-rome-part-2/