মানসিক ব্যাধি যখন স্কিজোফ্রেনিয়া

একটি ভয়াবহ মারাত্নক ও দুরারোগ্য মানসিক ব্যাধির নাম স্কিজোফ্রেনিয়া। এর ভয়াবহতা বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দেওয়া যাক-

যেমন ধরুন আপনি স্বপ্নে দেখলেন, আপনাকে কেউ হত্যা করার জন্য ছুটে আসছে আর আপনি জান নিয়ে পালাচ্ছেন। এরকম এক সময় হঠাৎ করে আপনার ঘুম ভেঙে গেল। ধড়াম করে উঠে বসে দেখবেন আপনি তখনো ভয়ে কাতরাচ্ছেন। কপাল দিয়ে দড়দড় করে ঘাম ঝরছে। তারপর বড় বড় করে শ্বাস নিয়ে নিজেকে সান্তনা দেবেন, “ভাগ্যিস এটা স্বপ্ন ছিলো।”

schizophrenic-hallucinations-and-delusions

আপনার ক্ষেত্রে তো সেটা দুঃস্বপ্ন মাত্র। কিন্তু জানেন কি, এর চেয়েও ভয়াবহ রকমের দুঃস্বপ্ন স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের তাড়া করে বেড়ায়। পার্থক্য হচ্ছে তারা ঐ স্বপ্ন ঘুমিয়ে দেখে না। জেগে জেগে দেখে থাকে। কতটা ভয়াবহ তাই না? দুঃস্বপ্ন হলেও নিজেকে আশ্বস্ত করা যায়, কিন্তু ব্যাপারটা যখন নিজের সামনে ঘটে তখন একটা মানুষের উপর দিয়ে কি যায় এটা বলার আর বাকি থাকে না।

স্কিজোফ্রেনিয়া এমন একটি রোগ যেটা মানুষকে একদম নিকৃষ্ট পর্যায়ের মানসিক রোগী বানিয়ে দিতে সক্ষম। এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে, এই বুঝি তাকে কেউ মেরে ফেলতে আসলো। তাদের সমস্যা হচ্ছে, তারা কল্পনা ও বাস্তবকে গুলিয়ে ফেলে এবং বাস্তবের চেয়ে কল্পনাতেই বেশি থাকে। তারা ধীরে ধীরে বাস্তবতার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে এবং নিজেদের তৈরি একটি অহেতুক কল্পনার জগতে ঘুরপাক খায়।

আশেপাশের মানুষ যা শুনতে পায় না তারা সেটা সেটা শুনতে পায়। আশেপাশের কিংবা সাধারণ মানুষ যা দেখতে পায় না তারা সেটা দেখতে পায়। এসব করতে যেয়ে তাদের অনেকে জিনিয়াস ভেবে বসে থাকে কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারা একটি মানসিক ব্যাধিতেই আক্রান্ত। তারা পরিবার বন্ধুবান্ধব সব কিছু থেকে সরে এসে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে। ঘর থেকে বাহিরে যেতে চায় না।

স্কিজোফ্রেনিয়া একটি মানসিক ব্যাধি বটে কিন্তু এ রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের পাগল বলা যায় না। কারণ আপনার অনেক কাছের মানুষও স্কিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত থাকতে পারে যা আপনি টেরও পাবেন না। আপনি ততোক্ষণ পর্যন্ত জানবেন না আপনার কাছের মানুষ এই রোগে আক্রান্ত যতোক্ষণ পর্যন্ত তারা নিজে থেকে আপনাকে কিছু না বলবে।

সাধারণত এদের দেখে বোঝার উপায় নেই এরা এতটা ভয়াবহ মানসিক রোগে আক্রান্ত। তবে রোগ যেহেতু, কিছু লক্ষণ তারা প্রকাশ করেই থাকে। যেগুলো দিয়ে অন্তত আঁচ করা যায় যে তারা স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। এগুলো হলো-

খুব দ্রুত কথা বলা
আবোল তাবোল বলা
সিদ্ধান্ত নিতে না পারা
একটি আলোচনা থেকে হুট করে অন্য আলোচনায় চলে যাওয়া
পারিবারিক কিংবা সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ না করা
আতঙ্কে থাকা
দেয়ালে ঘুষি দিয়ে নিজেকে নিজে আঘাত করার সময় কেউ চলে আসলে স্বাভাবিক হয়ে যাওয়া
জীবনের প্রতি আগ্রহ কমিয়ে দেওয়া
শরীরের যত্ন না নেওয়া
সীমিত আকারের আবেগ কিংবা আবেগহীন বললেও চলে
অনুপ্রেরণার অভাব
সবকিছু হুটহাট ভুলে যাওয়া
জিনিসপত্র হারিয়ে ফেলা
অর্থহীন জিনিসপত্র লেখা
বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি কিংবা অতি সাধারণ শব্দ বা দৃষ্ট বস্তু ধরতে না পারা

এরকম এক বা একাধিক লক্ষন অনেকের মধ্যেই দেখা যেতে পারে। কিন্তু তার মানে এই না যে সে ব্যাক্তিও উক্ত রোগে আক্রান্ত।

এই রোগের চিকিৎসা ডাক্তারদের জানা নেই। তবে বলা হয় এদের প্রচুর ভালোবাসা দিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়। তাছাড়াও ঘুমের ভেতর এনেস্থিসিয়া দিয়ে ইলেক্ট্রোড লাগিয়ে মাথায় কয়েকটা ইলেক্ট্রিক শক দিলে কিছুটা ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। আর ঔষধের ক্ষেত্রে antipsychotics ব্যাবহার করা যেতে পারে। এই ঔষধ অবশ্য স্কিজোফ্রেনিয়া থেকে রেহাই দিতে পারে না তবে, অতিরিক্ত চিন্তা করার ক্ষমতা, হ্যালুসিনেশন কিংবা ডিলিউসনের মতো ক্ষমতা কমিয়ে আনে। ফলে রোগী উল্টো পাল্টা চিন্তা করতে পারে না।

স্কিজোফ্রেনিয়া যেকোনো বয়সের, সকল নারী পুরুষের হতে পারে। তবে দেখা গেছে বয়ঃপ্রাপ্তির সময় বেশি দেখা যায় এবং দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। এটি হওয়ার কারণ নির্দিষ্ট নয়। তবে বংশগত কারণটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। বাবা-মায়ের এই রোগ থাকলে সন্তানের হওয়ার সম্ভাবনা ১০০%. এছাড়াও অতিমাত্রায় মাদক সেবন মাথার বারোটা বাজিয়ে দেয়। অনেকে সৃজনশীল ও দার্শনিক চিন্তা করতে যেয়েও এই রোগের শিকার হয়ে যান। মস্তিষ্কে কিছু ক্যামিকেল অনিয়মিত থাকতে পারে সেটা একজনের চিন্তা এবং আচরণের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।

স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা ভয়ংকর নয়। তবে তারা একা থাকতে পছন্দ করে। শুধু মানুষের সান্নিধ্য অপছন্দ তাদের। কেননা তাদের মনে মৃত্যু ভয়টা থাকে।

ওহ হ্যাঁ, একটা মজার তথ্য দিতে ভুলে গেছি। স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা মাত্রাতিরিক্ত সৃজনশীল হয়ে থাকে। সাধারণের চেয়ে তাদের চিন্তা করার ধারণা অনেক বেশি থাকে। তাই তাদের সৃজনশীলতা বেশি। প্রফেসর জন ন্যাশ একজন নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত গণিতবিদ। তিনিও স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। কোরিওগ্রাফার জগতের কিংবদন্তি নিজনস্কিও এই রোগে আক্রান্ত ছিলো বলে ধারণা করা হয়।

Similar Posts