বাগান
ইরা বাগান ভীষণ ভালোবাসেন। নানান রকমের বাহারি ফুল, ছোট বড় গাছ এসব দিয়ে বাসার চারপাশটা অনেক অনেক সবুজে ভরে থাকবে, তবেই না সেই বাসায় থেকে একটা শান্তিভাব আসে। এতদিনে তার শখপূরণ হয়েছে। বিশাল ব্যাকইয়ার্ডের এক বাসায় উঠেছেন তারা। ছোট এই শহরের বাসাটাই শুধু তার পছন্দ হয়েছে।
ছেড়ে আসতে কষ্ট হয়েছিল পরিচিত মুখগুলো, এতদিনের যত্নে সাজানো বাসাটা, আরো কতশত স্মৃতি। কত তাড়াতাড়িই না মায়া পড়ে যায় সবকিছুতে! ইমনেরও তো কজন ভালো বন্ধু হয়ে গেছিল। ওর ছেলেবেলার কত স্মৃতি থেকে গেছে সেখানে। স্বামীর চাকরিসূত্রে টেক্সাসের বড় শহর ছেড়ে মিসিসিপির এক ছোট্ট শহরে এসে উঠেছেন তারা। এদিকে আসার ইচ্ছা ইরার ছিল না একদমই। ডালাসে বেশ মানিয়ে নিয়েছিলেন। সবার সাথে পরিচয় হয়ে গেছিল। প্রায়ই বাঙালীদের আড্ডা, জমায়েত হত। সময়টা ভালো কেটে যেত। ইমনের বাবাকে তিনি বেশ ক’বার বলেওছিলেন অন্য কোথাও চেষ্টা করে দেখতে। কিন্তু সবসময় তো আর সবকিছু খাপে খাপে মিলে না!
এই ছোট্ট শহরটা বেশ নিরিবিলি আর চুপচাপ। চারপাশের সবুজটা অনেক বেশি চোখে পড়ে। মানুষের অভাব যেন গাছপালা পূরণ করে দিচ্ছে! শহরের একপাশে বিশ্ববিদ্যালয় আর সেটা ঘিরেই শহরটা এখানে গড়ে উঠেছে। ইরাদের বাসা বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব কাছে। তার স্বামী আগামী কয়েক মাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর দায়িত্বে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। ইরা বাসাটা মোটামুটি গুছিয়ে নিয়েই বাগানের কাজে নেমে পড়লেন। ডালাসে বাসার বারান্দাটা ছোট ছিল। চাইলেও অনেক গাছ সেখানে রাখা যেত না। এখানে তো আর সে বাধা নেই। ইরা একের পর এক কিনতেই থাকেন, মাটি, সার, বীজ, ছোট চারা, টব। শপিং এ গেলেই বাগানের জন্য কিছু না কিছু কেনা হয়ে যায়। অনেকদিন পর বাগানের নেশা তাকে আবারো পেয়ে বসেছে।
তাদের বাসার আশেপাশে অন্যান্য শিক্ষার্থীরা থাকে। বাঙালী শিক্ষার্থীও আছে তবে সংখ্যায় বেশ কম, হাতেগোণা কয়েকজন। ধীরে ধীরে সবার সাথে পরিচয় হয়। কেউ পরিবার নিয়ে থাকে, কেউ বা ব্যাচেলর। এদের মাঝে শীলা আর রিমিকে বেশ ভালো লেগে যায় ইরার। বয়সের পার্থক্যের কারণে তারা কিছুটা সংকোচ করলেও ইরার আন্তরিকতায় সেটা কেটে যায়। প্রায় বিকেলেই তিনি শীলা, রিমির সাথে হাঁটতে বের হন। দ্রুত পায়ের হাঁটা আর গল্পকথায় বিকেলগুলো দেখতে দেখতে শেষ হয়ে যায়।
মাস শেষে ইরার ব্যস্ততা বেড়ে যায়। বাংলাদেশে যাবেন ঠিক করেছেন। গাছগুলোকে নিয়ে একটু চিন্তা হচ্ছে, এরই মধ্যে বেশ ভালো বেড়ে উঠেছে তারা। তবে ইমনের বাবা হয়তো দেখে রাখতে পারবে, একটা মাসই তো। কিন্তু এদিকে অবস্থাটা মনে হচ্ছে সুবিধার ঠেকছে না। করোনা ভাইরাস নিয়ে চারিদিকে আতঙ্কিত সব খবর। আমেরিকাতে আক্রান্তের সংখ্যাটা অনেক বেশি। ভীষণ টালমাটাল একটা অবস্থা।
ইরার আর যাওয়া হল না। টিকেট ফেরত দিয়ে দিতে হল। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেল। শিক্ষার্থীরা অনেকেই নিজ নিজ শহরে ফিরে যাচ্ছে। ইরাদের কোথাও যাবার নেই। তারা বাসাবন্দী হয়ে পড়লেন। শান্ত শহরটা মনে হচ্ছে আরো শান্ত হয়ে গেছে।
বাসাবন্দী বিকেলগুলো খুব দীর্ঘ মনে হয়। শীলা, রিমির সাথে অনেকদিন দেখা হয় না। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হয়। ইরা আজকাল বাগানে আরো বেশি সময় দেন। তার যত্নের ছোঁয়ায় সব্জির ফলন বেশ ভালো হচ্ছে। তবে এতো সব্জি তাদের তিনজনের জন্য অনেক বেশি। ইরা ভেবেছিলেন কিছু সব্জি বাঙালী পরিবারগুলোতে দিয়ে আসবেন। কিন্তু সময়টাই এমন যে কাউকে বলাটা উচিত কাজ হবে কিনা ভেবে পাচ্ছেন না। তারা নিজেরাও গ্রোসারির ডেলিভারি আসলে দীর্ঘক্ষণ সেটা বাইরে রেখে তারপরে ঘরে নিয়ে আসেন। আর তারপরে ধোয়ামোছা তো রয়েছেই। এই তো সেদিন বাসায় যে গ্রোসারি ডেলিভারিটা আসল, সেটা ভুলে চলে এসেছিল। ইরারা তার অনেক কিছুই খান না। কিন্তু এই মহামারীর সময়ে বিক্রেতা দোকান সেটা আর ফেরতও নেয়নি। এতসব কিছু চিন্তা করে ইরার আর কাউকে কিছু বলা হয়ে ওঠে না। তবে শীলার কথা প্রায়ই মনে আসে। মেয়েটা সন্তানসম্ভবা। তাকে একটু রান্না করে খাওয়াতে পারলে ইরার খুব ভালো লাগত। এসময়ে তো কতকিছুই খেতে ইচ্ছে করে। পড়াশোনার চাপে মেয়েটা হয়তো ঠিকমতো রান্নাটাও করে উঠতে পারে না সবদিন। ওর মা বাবাও যে এর মাঝে শীলার কাছে আসতে পারবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। কিন্তু যদি কিছু হয়ে যায়! সময়টা তো ভালো না। একটা ভয় কাজ করে। ইরার ইচ্ছেটা তার মনেই থেকে যায়।
শীলা প্রথমে বুঝতে পারেনি যে সে গর্ভবতী। যখন সে প্রথমবার চেকআপে গেল, ডাক্তার তাকে বাসার বাহিরে যেতে পুরোপুরি নিষেধ করে দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের জন্য শীলা আগে থেকেই বাসায় বন্দী কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই বন্দীদশার কেমন একটা বাধ্যবাধকতা চলে আসল। শীলার কথা চিন্তা করে শুভ্রও বাসা থেকে বের হয় না, কারো সাথে দেখাসাক্ষাৎ করে না। সবাই ফোনে শীলার খোঁজখবর নেয়। শুভ্রও তার দিক থেকে চেষ্টার কমতি রাখে না। কিন্তু তারপরেও শীলার মনে হয় কেউ আসলে তাকে ঠিক বোঝে না। তার যে কেমন লাগে সেটা সে কাউকে বলে বোঝাতে পারেনা। রাতের পর রাত তার ঘুম আসে না। অথচ সকালের দিকে ঘুমের জন্য সে ক্লাসগুলোতে ঠিকমতে মনোযোগ দিতে পারে না। খুব খিটখিটে লাগে আজকাল। দিনের পর দিন শুভ্রকে দেখে সে বিরক্ত। মাঝে মাঝে তার মনে হয় ফলোআপের তারিখটা দ্রুত চলে আসুক। অন্তত ভিন্ন কারো সাথে দেখা হবে! কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ জ্বালাপোড়া করে। খেতে ইচ্ছে করে না। তার এবং শুভ্রর দু’জনের রান্নাই খুব বিস্বাদ ঠেকে। মায়ের রান্নার কথা মনে পড়ে প্রায়ই। শীলা অনেকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু তার রান্নাটা ঠিক মায়ের মতো হয় না। মা যে তরকারি, ভাজি, মাছ রান্না করত, সেগুলো এখানে পাওয়াও যায় না। পাশের শহরের বাঙালি দোকানে পাওয়া যায়। শুভ্র সেদিন বলছিল, পরিস্থিতি একটু ভালো হলে সে গিয়ে বাজার করে আনবে। শীলা অনেকবার ভেবেছে তাদের এপার্টমেন্টের ছোট্ট বারান্দাটায় কিছু দেশি সব্জির গাছ লাগাবে, কিন্তু কেন যেন হয়ে উঠেনি।
আজও শীলা ক্লাসের শেষে ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাতে ঘুম না আসলেও দিনের বেলায় তার খুব ভালো ঘুম হয়। শুভ্র আজ একটু বাইরে গিয়েছে। ঘুম ভেঙে উঠে মুঠোফোনটা চেক করতে গিয়ে শীলা ইরার মেসেজ পেল। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে বাসার বাইরে বড় একটা প্যাকেট রাখা। শীলা তাড়াতাড়ি সেটা ভেতরে নিয়ে এসে খুব আগ্রহ নিয়ে খুলতে থাকে। ইরা ভাবী এতো কিছু রান্না করেছে! চট করে ভাতটা গরমে বসায় শীলা। প্রথমবারে আলু-করলা ভাজিটা মুখে নিয়ে সে কেঁদে ফেলে। এগুলো নিশ্চয় ভাবীর বাগানের সব্জি। তার মনে পড়ে প্রতিবার ছুটিতে সে যখন হোস্টেল থেকে বাসায় ফিরত, মা তখন তার পছন্দের খাবারগুলো রান্না করে রাখত- লাউ দিয়ে মুগডাল, পুঁইশাক চিংড়ি, বড়ি দিয়ে মাছের ঝোল আরো কত কি! সে কখনো ইরা ভাবীকে এসব বলেছে বলে মনে পড়ে না। কিন্তু তারপরেও মানুষগুলো কিভাবে যেন বুঝে ফেলে! শীলা খাবারের থালাটা পাশে সরিয়ে রেখে অনেকক্ষণ ধরে চোখ মুছতে থাকে। বাসার কথা খুব বেশি মনে পড়ছে।
ইরা মাত্র চা বানিয়ে বাগানে এসে বসেছেন। মুঠোফোনটা আওয়াজ করে উঠল। শীলার মেসেজ। লিখেছে, “ভাবী আমি ঠিক গুছিয়ে লিখতে পারিনা। তবে আজ অনেকদিন পর তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছি। বাসার কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল। আবারও অপেক্ষায় থাকব। আর এরপরে প্যাকেটের সাথে আপনিও ভেতরে এসেন“। ইরার ঠোঁটে জলভরা হাসি ফুটে ওঠে। তার ভেতরে থেকে একটা ভার নেমে যায়।