সাগরকন্যা কুয়াকাটার ভ্রমণ গাইড

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনপ্রিয় সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত দেখার স্থানের কথা যদি বলা হয়, তবে সবার মনে যে নামটি সর্বপ্রথম উদয় হবে, তা হলো “কুয়াকাটা”। কুয়াকাটা নৈসর্গিক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা একটি সমুদ্র সৈকত যা পর্যটকদের কাছে  “সাগর কন্যা” হিসেবে পরিচিত । ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সৈকতের বালুকণার উপর আপনার পদচারণা যদি ইতোমধ্যে হয়ে থাকে, আপনি নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতে পারেন। কারণ, এখনো অনেকেই এই বালুকাবেলায় পদচারণার সুযোগ পায়নি। সুযোগবঞ্চিত অথচ ভ্রমণপিপাসু মানুষদের জন্যই আমার আজকের লেখনি তাঁদের ভবিষ্যত ভ্রমণে সহায়তার ক্ষুদ্র প্রয়াস।

সাগরকন্যা কুয়াকাটা

জনসংখ্যা ও অবস্থান:

কুয়াকাটার স্থানীয় জনসংখ্যা সরকারি ২০১১ সালের আদমশুমারির হিসাব মতে ৯০০০ এর ও বেশি। বাস্তবিকভাবে এই সংখ্যা আরও বেশি বর্তমান সময়ে।

বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালি জেলার কলাপাড়া উপজেলার মহিপুর থানার লতাচাপলী নামক ইউনিয়নে কুয়াকাটা অবস্থিত। অবস্থানগত দিক থেকে কুয়াকাটা ভ্রমণ পূর্বে বেশ কষ্টদায়ক এবং সময় সাপেক্ষ একটি ব্যাপার ছিল। যদিও, এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্ঠ উন্নয়নের ফলে খুব সহজেই কুয়াকাটা ভ্রমণ করা সম্ভব।

বাংলাদেশের একমাত্র সমুদ্র সৈকত হিসেবে কুয়াকাটা জাতীয় পর্যায় ছেড়ে বৈশ্বিক মহলেও নাম ডাক করে নিয়েছে একই সাথে সূর্যদয় ও সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য দর্শকদের সামনে উপস্থাপনের জন্য। বলে রাখা ভালো, সূর্যোদয় সবচেয়ে ভালো দেখতে পারবেন পূর্ব পাশের “গঙ্গামতীর বাঁক” নামক স্থান থেকে।

যেভাবে এলো “কুয়াকাটা” নাম:

ঘুরতে যাবেন অথচ সে জায়গার ইতিহাস জানবেন না, তা কি করে হয়? কুয়াকাটা নামটি আসার মজার একটি ইতিহাস রয়েছে। কুয়া শব্দটি মূলত বাংলা “কূপ” হতে আগত শব্দ। ধারণা করা হয় যে ১৮ শতকে মুঘল শাসক কর্তৃক বার্মা হতে বিতাড়িত হয়ে আরাকানরা এ অঞ্চলে বাসস্থান গড়ে তোলে।

জনবসতি যেখানে, সেখানে তো স্বাভাবিকভাবেই পানির চাহিদা থাকবে। তাই, প্রচুর পানির কূপ খনন করা হয়এই অঞ্চলে। সেই থেকে কূপ বা কুয়া এই অঞ্চলের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং কালের পরিক্রমায় এলাকার নাম হয়ে যায় কুয়াকাটা।

যাতায়াত এর নিয়ম:

বিভাগীয় শহর ঢাকা হতে কুয়াকাটা দুইভাবে যেতে পারবেন।

১.লঞ্চযোগে
২.বাসযোগে

লঞ্চযোগে যেতে চাইলে অবশ্যই বরিশালে এসে নামতে হবে। ঢাকা সদরঘাট থেকে সরাসরি লঞ্চ ছেড়ে আসে নিয়মিত বরিশালের উদ্দ্যেশ্যে। ডেক, সিঙ্গেল কেবিন, ভিআইপি কেবিন সব ধরণের সুবিধাই লঞ্চে পেয়ে যাবেন।

লঞ্চ থেকে নেমে শহরের রূপাতলী এলাকায় আসতে হবে। মাহিন্দ্রা ভাড়া নিবে ১০ টাকা। রূপাতলী থেকেই সরাসরি কুয়াকাটার বেশ কিছু গাড়ি পেয়ে যাবেন।

বাসযোগে যেতে চাইলে ঢাকা থেকে সরাসরি কুয়াকাটার বাস রয়েছে। নন এসি বাস ভাড়া ৬৫০ টাকা ও এসি বাস ভাড়া ১১০০ টাকা। সাকুরা পরিবহনের গাড়ি নিয়মিত এই রুটে চলাচল করে।

আবাসন এবং আহার ব্যবস্থা:

পর্যটকদের সুবিধার্তে কুয়াকাটায় অসংখ্য হোটেল এবং কটেজ রয়েছে। একদম কম দাম থেকে শুরু করে যেকোনো মূল্যের হোটেল পেয়ে যাবেন। আপনার বাজেটের উপর নির্ভর করে আপনি হোটেলে উঠে যাবেন।

এবার খাবারের কথায় আসি। যেহেতু বিচ এলাকায় ঘুরতে এসেছেন, মুরগি প্রেমীরা অন্তত একটা দিন ভিন্ন কিছু খান। হোটেলে ঢুকে মুরগির মাংস না নিয়ে শুটকি ভর্তা খান, বিভিন্ন ধরণের সামুদ্রিক মাছ খান। বিকালে বিচে গিয়ে কাঁকড়া ফ্রাই খেতে পারেন। সাথে রূপঁচাদা, টোনা,লবস্টার ইত্যাদি তো আছেই।

যেখানে যেখানে ঘুরবেন:

এতক্ষণ তো সব গৌণ বিষয়ে আলোকপাত করলাম। এবার মুখ্য বিষয়ে আসা যাক। আমাদের মুখ্য বিষয়টা হলো ভ্রমণ। ভ্রমণের জন্য বেশ কিছু স্পট রয়েছে। সেই স্পটগুলোর সবগুলোয় একদিন যাওয়া সম্ভব না। তবে, সুবিধামত বাছাই করে যতগুলোয় সম্ভব ঘুরে আসবেন।

১. কুয়াকাটার কুয়া:

কুয়াকাটার কুয়া রাখাইন পল্লিতে অবস্থিত। তারজালি দিয়ে পুরা কুয়াটি ঘেরা অবস্থায় থাকে। অতি উৎসাহী হয়ে ভিতর থেকে কুয়ার ছবি তুলতে গিয়ে আপনার মূল্যবান ইলেকট্রনিক ডিভাইস হারালে আফসোস ছাড়া কিন্তু আর কিছুই করার থাকবেনা আপনার।

২. কাউয়ার চর:

সারি সারি লাল কাঁকড়া দল বেধে হেঁটে বেড়াচ্ছে, আপনাকে দেখে সবাই একসাথে নিজেদের গর্ত করা নিরাপদ স্থানে লুকিয়ে পড়লো- কেমন লাগবে এই দৃশ্য দেখতে? অবশ্যই অনেক দৃষ্টিনন্দন একটি দৃশ্য। কাউয়ার চরে গেলে এই মনমুগ্ধকর দৃশ্যটি দেখতে পারবেন খুব সহজেই।

৩. ঐতিহ্যবাহী শতবর্ষী নৌকা:

বাংলার অতীত জানতে হলে, শক্তিশালী নৌ প্রকৌশলবিদ্যার নিদর্শন স্বচক্ষে  অবলোকন করতে হলে আপনাকে দেখতে হবে বিশালাকার এই নৌকাটি। সম্পূর্ণ নৌকা কাঠ দিয়ে তৈরী।

৪. চর গঙ্গামতী:

সূর্যোদয় দেখতে চাইলে এখানে চলে আসবেন। চর গঙ্গামতী থেকে আপনি সর্ব পূর্বে জেগে উঠা টকটকে লাল সূর্যের আভা স্বচক্ষে দেখতে পারবেন এবং অনুভব করতে পারবেন এর বিশালতা। ছবি তোলার জন্য খুব সুন্দর এই জায়গাটি।

৫. বৌদ্ধবিহার:

মিশ্রিপাড়ায় অবস্থিত বৌদ্ধ বিহারে ঘুরে আসতে পারেন। এর সৌন্দর্য এবং নির্মাণশৈলী আপনাকে বিমোহিত করবে।

৬. রাখাইন পল্লী:

ভ্রমণে এসে কেনাকাটা করতে পছন্দ করে এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়। জ্বি, তাঁদের জন্য সুখবর। রাখাইন পল্লী থেকে আপনার পছন্দের পোষাক, খাবার সব কিছু কিনে নিতে পারবেন। অন্য সব দর্শনীয় স্থানের মত এরা মোটেই গলাকাটা দাম দাবি করে না। যথেষ্ঠ সুলভ মূল্যেই আপনার পছন্দের পণ্য পেয়ে যাবেন এখানে।

৭. শুটকি পল্লী:

যারা শুটকির গন্ধ সহ্য করতে পারেন না, তাদের জন্য এটা নরকতুল্য। আর যারা পারেন এবং শুটকি-প্রেমিক, তাঁদের কথা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। শুটকি পল্লীতে সব ধরণের মাছের প্রচলিত শুটকি পেয়ে যাবেন।

৮. লিম্বুর চর:

লেবুর চর বা লিম্বুর চর যে যাই বলুক স্থানীয়রা, এই জায়গায় আসলে মন ভালো হতে বাধ্য। সূর্যাস্ত যাওয়ার সময় যদি প্রকৃতির কোলে একান্তই মিশে যেতে চান, এখানে যেয়ে ঘুরে আসতে পারেন। হতাশ হবেন না নিশ্চিত থাকুন।

৯. ফাতরার বন:

এটি মূলত সুন্দরবনের পূর্বাংশ। ছবি তোলার জন্য ভালো জায়গা। সমুদ্রের ওপাড়ে সুন্দরবনের আরেক অংশ চোখে পড়বে যেটা মূলত ভারতের মধ্যে অবস্থিত।

১০. তিন নদীর মোহনা:

তিন নদীর মোহনায় মূলতে সাগরের সাথে তিনটি নদী মিশে গিয়েছে। বিচে দাড়িয়ে মোহনা দেখার সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করবেন না কিন্তু।

১১. ঝিনুক বিচ:

নাম শুনেই বুঝতে পারছেন যে এখানে ঝিনুক পাওয়া যায় অনেক। যাদের ঝিনুক সংগ্রহের শখ রয়েছে, ঘুরে আসতে পারেন ঝিনুক বিচ থেকে।

পরিশেষ:

ভ্রমণ গাইডে একটি স্থানের পূর্ণাঙ্গ বর্ণনা দেওয়া কষ্টসাধ্য ব্যপার। তারপরেও চেষ্টা করা হয়েছে আমার বেশ কয়েকবার ভ্রমণের অভিজ্ঞতার আলোকে বেশ কিছু জিনিস তুলে ধরার।

কুয়াকাটার সুখ্যাতি কিন্তু দেশের বাইরেও বিস্তৃত। এখানে প্রচুর দেশি পর্যটক আসলেও বিদেশি পর্যটকরাও আসে। আমরা বাঙালি হিসেবে কখনো যেনো আমাদের বহিরাগত অতিথিদের কাছে ঋণাত্মক চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ না ঘটাই। বিচ পরিস্কার রাখতে সহয়তা করবেন এবং অযথা ময়লা-আবর্জনা ফেলবেন না কেউ।

ভ্রমণের সময় সাবধান থাকুন পকেটমার সহ যাবতীয় দুষ্কৃতিকারীদের থেকে। পাওয়ার ব্যাংক ব্যবহার করুন আপনার ডিভাইসের চার্জ সংকট এড়াতে। একা ভ্রমণ না করে দল বেধে ভ্রমণ করুন। পর্যাপ্ত ঔষধ এবং অর্থ সঙ্গে রাখুন।

সবার জন্যে কুয়াকাটা ভ্রমণের শুভকামনা থাকলো।

Similar Posts

2 Comments

  1. আচ্ছা, কাউয়ার চর নামটা খুবই অদ্ভূত না। এর পিছনে রহস্যটা কি জানতে পেরেছেন? কাক এর সাথে কি এর কোন সম্পর্ক আছে? তাহলে আবার কাঁকড়া কেন

    1. না কাকের সাথে কোন সম্পর্ক নেই। স্থানীয় দের মাঝে এটি প্রচলিত। আসল রহস্য জানা নেই। ধন্যবাদ।

Comments are closed.