লেক মিশিগান তীরের শিকাগো শহর (শেষ পর্ব)

গত পর্বের পরে –

শিকাগো নদীর ওপরে যে লোহার সেতু ছিল, আতঙ্কিত মানুষ সেটা পার হয়ে শহরের অন্য প্রান্তে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকে। তারপর তাদের পায়ের নিচের সেই সেতুও আগুনের তাপে গলতে শুরু করে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা লেক মিশিগানের জল আগুনে ছিটাতে থাকে, কিন্তু সেটা যথেষ্ট ছিল না। একসময় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রগুলোও কাজ করা বন্ধ করে দেয়। শহরের সব মানুষ লেকের দিকে ছুটে যায়। লেক মিশিগানের জলে সারারাত দাঁড়িয়ে মানুষ অসহায় চোখে তাদের প্রিয় শহরকে পুড়তে দেখে। শহরের সাথে তাদের স্বপ্ন আর সঞ্চয়ও পুড়তে থাকে। অবশেষে বৃষ্টিতে সেই আগুন নিভে যায়। এই ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ইতিহাসে “গ্রেট শিকাগো ফায়ার” (The Great Chicago Fire) নামে পরিচিত।

travel-to-chicago-part-2

অগ্নিকান্ডে শিকাগোর প্রচুর ক্ষতি হয়, অল্প কিছু ইঁটের ভবন ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। কেউ কেউ পালিয়ে যাবার আগে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিস মাটির নিচে চাপা দিয়ে যায়, কিন্তু আগুনে সেটাও গলে যায়। পুরো শহর এক ভয়াবহ কালো ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। যে নিউইয়র্ক শহর একসময় শিকাগোর সাথে পাল্লা দিত, তাদের চেয়ে শিকাগো পিছিয়ে পড়ে। সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন জায়গা থেকে সাহায্য় আসতে থাকে। শিকাগোবাসীরা আগের চেয়েও বেশি পরিশ্রম করতে থাকে। তারপরে ত্রিশ বছরেরও কম সময়ে শিকাগো আবার দাঁড়িয়ে যায়। কাঠের যে শহর অসহায়ভাবে ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গিয়েছিল, সেখানে থেকে জন্ম নেয় সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ইস্পাতের এক শহর।

মিলেনিয়াম পার্ক
মিলেনিয়াম পার্ক

এই যে শহরে এত এত আকাশছোঁয়া ভবন, তাদের যান্ত্রিকতা ভুলিয়ে দেবার জন্য সবুজের অভাবও নেই এই শহরে। মিলেনিয়াম পার্ক, লিংকন পার্কের সবুজের ছোঁয়া আর সুন্দর কিছু স্থাপত্যশৈলী দেখতে দেখতে হেঁটে যাবার সময় মনে হবে ইস্পাত, সবুজ, ইঁটপাথর, বিশাল জলরাশি সবকিছুই এক চমৎকার মেলবন্ধনে বাঁধা এই শহরে। তবে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছে লেক মিশিগানকে। এর বিশালতা আমাকে মুগ্ধ করেছে, লেক মিশিগানের জন্যেই শিকাগো শহর এতটা সুন্দর। প্রথম দেখায় একে সমুদ্র ভেবে ভ্রম হয়, এর বিশালতা আর ঢেউ এর জন্য। এই লেকের পাশে বসে যদি হাজারটা সন্ধ্যাও কাটাই, তারপরেও আমার মন ভরবে না, ইচ্ছে করবে আবার যেতে।

শিকাগোর আকাশছোঁয়া ভবনগুলোর ওপরে থেকে লেক মিশিগানকে অন্যরকম সুন্দর দেখায়। শিকাগোর উচ্চ ভবনগুলো পর্যটকদের কাছে আরো একটা কারণে বেশ আকর্ষণীয়, সেটা হচ্ছে- উচ্চমূল্যের টিকিটের বিনিময়ে এই ভবনগুলোর ওপরে থেকে পুরো শহরটাকে দেখা যায় এবং তখন সেটাকে সম্পূর্ণ অন্যরকম দেখায়। এটা শিকাগো পর্যটনে বেশ বড় জায়গা দখল করে আছে। রাতে শহরে অনেক অনেক আলো জ্বলে ওঠে। তখন নিচে তাকিয়ে রাস্তায় চলতে থাকা সারি সারি গাড়ি দেখে মনে হয় যেন অনেকগুলো আলোকিত পিঁপড়া হেঁটে চলেছে।

লিংকন পার্ক
লিংকন পার্ক

ভালো থাকুক লেক মিশিগান; যদিও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এর ওপরে পড়তে শুরু করেছে। শীতকালে এখন লেকে আগের চেয়ে অনেক কম বরফ জমাট বাধে। শুধু লেক মিশিগানই নয়, বাকি চারটা গ্রেট লেকেরও একই অবস্থা। গ্রেট লেক (লেক হারন, লেক অন্টারিও, লেক মিশিগান, লেক ইরি, লেক সুপিরিয়র) নামকরণের কারণ এই লেকগুলো একত্রে আয়তনে অনেক বড়, প্রায় ছোট এক সমুদ্রের সমান। শুধু শিকাগো নয়, এই লেকগুলোর তীরবর্তী আরো অনেক শহরের অস্তিত্ব টিকে রয়েছে এই লেকগুলোর ওপরে। সকলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যেই এই জলবায়ু পরিবর্তন দ্রুত ঠেকানো খুব বেশি প্রয়োজন।

যদি কখনো সুযোগ হয়, তাহলে আবারো দেখা হয়ে যাবে লেক মিশিগানের সাথে কোন এক মেঘলা বাতাসভরা বিকেলে, অথবা কোন এক সন্ধ্যায়। শিকাগো ঘুরে বেশ ভালো লেগেছিল এবং সেই ভালোলাগা নিয়েই এই লেখা।

তথ্যসূত্র: (বই- “What was the Great Chicago Fire” by Janet B. Pascal)

Similar Posts