জুনায়েদ হাসান রানা / এপ্রিল 30, 2020
গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি নেত্রকোণা জেলার অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবেন খুব সহজেই। সমৃদ্ধ এ জনপদের পরতে পরতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নৈসর্গিক সব পর্যটন স্পট। এ মাটির ছায়ায় মায়ায় বেড়ে উঠেছেন দেশবরেণ্য কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, আলেম, সাংবাদিক। অসংখ্য নদী, খাল-বিল, হাওড়, জলপ্রপাত এবং পাহাড়বেষ্টিত এ জেলার ধান আর মাছ পূরণ করে আসছে সারাদেশের অগণিত মানুষের চাহিদা। নেত্রকোণা জেলার গয়ানাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের ‘বালিশ মিষ্টির’ প্রশংসা দেশজুড়ে। ইসলাম প্রচারক সুফী শাহ সুলতান কমর উদ্দিন রুমীর (রহ.) স্নেহধন্য প্রাচীন ইতিহাস, ঐতিহ্যে ঘেরা এ লোকালয়কে ঘিরে রয়েছে নানা লোককাহিনী আর কিংবদন্তি।
ঢাকা থেকে ১৬২ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত নেত্রকোণা জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৪ সালে। ময়মনসিংহ বিভাগের এ জেলাটি ১০ টি উপজেলা, ৫ টি পৌরসভা এবং ৮৬ টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত। শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোণা মেডিকেল কলেজের মতো অসংখ্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে কাজ করে যাচ্ছে অবিরত। এ জেলায় প্রাচীনকাল থেকে বসবাস করে আসছে গারো, হাজং, হদি, বানাইসহ অসংখ্য উপজাতি।
ভ্রমণপিয়াসীদের সবসময় হাতছানি দিয়ে ডাকে নেত্রকোণা জেলার দর্শনীয়, নৈসর্গিক স্থানগুলো। মেঘালয়ের পাদদেশে ছোট, বড় অসংখ্য পাহাড় এবং তা থেকে কলকল রবে বয়ে আসা স্বচ্ছ ঝর্ণাধারা আলোড়িত করে প্রতিটি হৃদয়কে। দূর্গাপুরের বিজয়পুর চীনামাটির পাহাড় যার বুক চিরে জেগে উঠেছে নীলচে-সবুজ পানির হ্রদ। পাহাড়ের বিস্তৃত সাদা মাটি আর হ্রদের নীলাভ-সবুজ পানি, যে নৈসর্গিক দৃশ্যের অবতারণা করে, তা দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই।
নেত্রকোণা জেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের একমাত্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি। এ অঞ্চলে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীদের জীবনযাত্রার নানা নিদর্শন সংরক্ষিত আছে এই একাডেমিতে। এছাড়াও কৃষক ও টংক আন্দোলনের প্রথম শহিদ হাজং মাতা রাশমণি স্মৃতিসৌধ, ১৯১২ সালে প্রতিষ্ঠিত ক্যাথলিক গির্জা ও সাধু যোসেফের ধর্মপল্লী, সুসং দূর্গাপুরের জমিদার বাড়ি আপনাকে নিয়ে যাবে সোনালী ইতিহাসের পরতে পরতে। এখানে রয়েছে ১৯৪৬-৫০ সালে কমরেড মণি সিংহের নেতৃত্বে পরিচালিত টংক আন্দোলনের শহিদদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিসৌধ যাতে প্রতিবছর তিনদিনব্যাপী ‘মণি মেলা’ নামে লোকজ মেলা বসে। কিংবদন্তির কমলা রাণীর দীঘিও অবস্থিত দূর্গাপুরে। জেলার কেন্দুয়ার রোয়াইল বাড়িতে আছে ‘সুরক্ষিত দূর্গ’ যা ঈশা খাঁর আমলের বহুপূর্বে পাল বংশের রাজারা তৈরি করেছিলেন। কেন্দুয়ার জাফরপুরে রয়েছে খাজা উসমানের সময়ে খনন করা ১৮.৩৩ একরের একটি দীঘি যা ‘খোজার দীঘি’ নামে পরিচিত।
ভারত সীমান্ত ছুঁয়ে সারি সারি পাহাড়, টিলা, নদী, আদিবাসী জীবনধারা ও ইতিহাস – সবকিছুর অপূর্ব মেলবন্ধনে জেলার কলমাকান্দা উপজেলার লেংগুড়া সৃষ্টি করেছে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। এখানে চারপাশে মেহগনি গাছের সারির নির্জন জায়গায় অবস্থিত সাত শহিদের মাজার, যাতে সমাহিত আছেন ৭ জন মুক্তিযোদ্ধা। নেত্রকোণা জেলায় প্রায় ৫৬ টি হাওর ও বিল রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে নৌকায় করে হাওরে ঘুরে বেড়ানোর সময় গ্রামগুলোকে একেকটি ছোট্ট দ্বীপের মতো মনে হয়।
এক নিরিবিলি শান্তির জেলা হলেও স্বাধিকার এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কখনো পিছিয়ে ছিলো না এ জনপদ। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, টংক আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, ফকির বিদ্রোহ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে জীবনবাজি রেখে লড়াই করেছে এ মাটির সূর্যসন্তানেরা। বাংলাদেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ প্রতিটি অঙ্গনে রয়েছে এ জেলার মানুষদের দীপ্ত পদচারণা। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ, চর্যাপদের কবি কাহ্ন পা, লেখক হুমায়ূন আহমেদ, লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, কবি নির্মলেন্দু গুণ, কবি হেলাল হাফিজ, কলকাতার সাবেক মেয়র নলিনীরঞ্জন সরকার, সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল আবু তাহের, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা কমরেড মণি সিংহ, প্রখ্যাত সাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরী, প্রখ্যাত সাংবাদিক ও সাহিত্যিক মুজীবুর রহমান খাঁ, রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী শৈলজারঞ্জন মজুমদার, প্রখ্যাত লোক গায়ক মনসুর বয়াতি, খ্যাতিমান বংশীবাদক বারী সিদ্দিকী, কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ মোস্তফা জব্বার, প্রাক্তন মন্ত্রী আব্দুল মমিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ড. আনোয়ার হোসেন এ জেলারই কৃতি সন্তান।
লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির এক উর্বর ভূমি নেত্রকোণা জেলা। এ ভূমিকে কেন্দ্র করে বর্ণিত হয়েছে নানা লোকগাঁথা, কিংবদন্তি আর কল্পকাহিনী। নেত্রকোণার সন্তান চন্দ্রকুমার দে সংগৃহীত ও ড. দীনেশ চন্দ্র সেন সম্পাদিত ময়মনসিংহ গীতিকা বিশ্বনন্দিত এক রত্নভান্ডার। নেত্রকোণার বাউল সংগীত, পালাগীত, গারো সম্প্রদায়ের প্রবাদ, ছড়া, হাজং সম্প্রদায়ের শ্লোক (হিলুক), ধাঁধাঁ (থাচিকথা), গান (গাহেন) লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ।
সোমেশ্বরী, মগড়া, কংস, ধনু এবং ধলাইসহ অগণিত নদীবিধৌত এ জেলা প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। অফুরন্ত মৎস্য ভাণ্ডার, শস্য ভাণ্ডার, চীনা মাটির খনি, বিভিন্ন খনিজ সম্পদ এ জনপদকে করেছে সমৃদ্ধ। সুষ্ঠু পরিকল্পনা করে প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ এবং পর্যটন স্পটগুলোর দিকে বিশেষ নজর দিলে এ জেলা হয়ে উঠবে আরো সমৃদ্ধ।
বালিশ মিষ্টি খেতে খেতে অবারিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে সময়-সুযোগ করে ঘুরে যেতে পারেন স্বর্গভূমি নেত্রকোণায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
Comments are closed.
Comments
Kader says
মাশা আল্লাহ! অসাধারণ একটি ভূমি নেত্রকোনা।
– ভাই, চট্টগ্রাম থেকে কত কিলোমিটার দূরে হবে?
Rana says
২৯৭ কিলোমিটার দূরে। নেত্রকোণায় বেড়ানোর দাওয়াত রইলো ভাই।
Kader says
প্রথমত আপনাকে ধন্যবাদ!
তবে এই লকডাউনের মধ্যে ওখানে বেড়াতে যাওয়া একদমই অসম্ভব..
Kader says
রানা ভাই, সম্প্রতি আপনার লেখাগুলো আমি পড়েছি,
আপনি অনেক ভালই লিখেন। লেখালেখি চালিয়ে যান।
Rana says
ধন্যবাদ ভাই। দোয়া করবেন। আপনাদের উৎসাহ পেলে সামনে আরো ভালো করতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
Kader says
ইনশা-আল্লাহ! দো’আ রইলো ভাই
Md. Jahid Al Azom says
আলহামদুলিল্লাহ নেত্রকোণা বিরিশিরি ভ্রমণের সৌভাগ্য হয়েছে আমার। এছাড়া শহরে যাওয়া হয়েছে। আসলেই চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ সেখানে। বিশেষ করে চিনামাটির পাহাড় সত্যিই অসাধারণ। তবে যোগাযোগ ব্যবস্থা একটু ভুগিয়েছে।
Mehedi Hasan Khan says
বিরিশিরি যাওয়ার প্ল্যান ছিলো। এরমধ্যেই চলে আসলো করোনার প্রকোপ! 🙁
tasnim says
ভ্রমনপিয়াসী হওয়া সত্ত্বেও মা-বাবা দুজনই চাকুরীজীবি হওয়ায় ঢাকার বাহিরেই পা রাখা তেমন সম্ভব হয়না। আবার তাদের মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকার কারনে বন্ধুবান্ধবদের সাথেও ঘুরতে যাওয়ার অনুমতিটা দিতে চায় না। হয়তো সারাজীবন এরকম আর্টিকেল পড়েই কল্পনায় ভ্রমণ করে বেড়াতে হবে সারাজীবন। তবে লেখাটা দারুণ ছিলো। খুব আবেগ দিয়ে লিখেন আপনি বোঝা গেল।